আপনার দেখা সবথেকে অদ্ভুতুড়ে উৎসব কোনটি? অনেকে হয়তো শিয়াদের মহররম উদযাপনে পিঠ রক্তাক্ত করার কথা বলবেন। তবে সেটাকে অবশ্য উৎসব বলা যায় না। সেটা অনেকটা শোক উৎযাপন। এমনিতে আমাদের দেশের অদ্ভুতুড়ে উৎসব খুব একটা নেই। পাহাড়ি এরিয়াতে হয়তো কিছু কিছু আছে। যাই হোক, চলুন জেনে নেওয়া যাক পৃথিবীর কোণা-কাঞ্চিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আজব ও অদ্ভুতুড়ে কয়েকটি ফেস্টিভাল সম্পর্কে।
এল কোলাচো
(স্পেইন)
অনেকেই হয়তো ভিডিওটি দেখে চরম অস্বস্তি অনুভব করেছেন। তবে
চোখের ভুল না, আপনি ঠিকই দেখছেন। স্পেনে ১৬২০ সাল থেকে এই উৎসব
হয়ে আসছে। একে স্প্যানিশ ভাষায় ‘কাস্ট্রিলো ডি মুরসিয়া’ অথবা ‘দ্য বেবি জাম্পিং
ফেস্টিভ্যাল’ও বলা হয়। এটি স্প্যানিশদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবে ভয়ানক সব
মুখোশধারী মানুষ শয়তান সেজে ঘুরে বেরায়। তারা মিছিল করে মূল উৎসবে আসার আগে রাস্তায়
মানুষকে নানাভাবে ভয় দেখায়। উৎসবের জন্য নির্ধারিত স্থানে রাস্তায় ছোট ছোট বিছানায়
শিশুদের শুইয়ে রাখা হয়। আর তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায় মুখোশধারীরা।
স্প্যানিশরা বিশ্বাস করে যে, এর মাধ্যমে অশুভ শক্তি
শিশুদের না ছুঁয়ে ওপর থেকে চলে যায়। শিশুদের ভাগ্য থেকে অশুভ শক্তিকে তাড়ানোই এই
উৎসবের মূল উদ্দেশ্য।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
হাদাকামাতসুরি
(জাপান)
জাপানের ডজনখানেক জায়গায় গরমে অথবা শীতে এই উৎসবটা হয়ে
থাকে। অংশগ্রহনকারীরা "ফানডোসি" নামের এক ধরনের কাপড় পড়ে থাকে, ফানডোসি অনেকটা আমাদের দেশিয় নেংটির মত। যা হোক, সব ফানডোসি পরিহীতদের মাঝে একজন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তাদের মাঝে লুকিয়ে
থাকে। তারা বিশ্বাস করে, ঐ উলঙ্গ লোকটাকে ছুঁতে পারলে
তাদের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আসবে। সুখের জন্য মানুষ কতই না উদ্ভট কাজ-কারবার করে
বেড়ায়!
নাকি সুমো (জাপান)
এই উৎসবে সবার নজর থাকে সুমো পালোয়ানদের দিকেই। তবে এখানে
তারা মারামারি করে না। দুজন পালোয়ানের কোলে তুলে দেওয়া হয় দুই বছরের কম বয়সী একটি
করে শিশু। নিজেদের কোলের শিশুকে কমফর্টেবলি ধরে দোল দিতে থাকে তারা। আর একজন লোক
পালাক্রমে শিশুর দিকে চেয়ে ‘নাকি নাকি’ অর্থাৎ কাঁদো কাঁদো বলে চিৎকার করতে থাকেন।
যেই শিশুটি আগে কেঁদে উঠবে তাকে ভাবা হয় ভাগ্যবান।
জাপানিরা বিশ্বাস করে, নাকি সুমোতে শিশুরা
কাঁদলে তাদের ভবিষ্যত জীবনের কান্না ও দুর্ভাগ্য শেষ হয়ে যায় এবং সৌভাগ্য চলে আসে।
যদি কোনো শিশু সুমোর কোলে না কাঁদে, তাহলে ভাবা হয়
শিশুটির অমঙ্গল হতে পারে। টোকিওতে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে পালিত হয় ‘নাকি সুমো’
নামের অদ্ভুত এই উৎসব।
দ্য মানকি
ব্যুফে ফেস্টিভাল (থাইল্যান্ড)
ব্যুফে লাঞ্চ ও ডিনার, ভিআইপি কে জানেন?
বানর! রামায়নের বানরদের রাজা হনুমানের সম্মানে এই উৎসব পালন করা
হয় থাইল্যান্ডে। প্রায় ৩ হাজার কেজি ফল ও শাকসবজি দিয়ে এই ব্যুফে সাজানো হয়। প্রায়
৬০০ আমন্ত্রিত অতিথি বানর মহাশয়দের আপ্যায়ন করার জন্য।
কুপারস হিল চিজ
রোলিং (ইংল্যান্ড)
পাবলিকের খেয়ে-দেয়ে কাজ না থাকলে যা হয়! ইংল্যান্ডের
গ্লুচেস্টারে অবস্থিত ‘কুপারস হিল’ নামক একটি ছোট পাহাড়ে প্রতি বছর মে মাসে
অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। ৭ পাউন্ডের চিজের চাকতি কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল পাহাড় থেকে
গড়িয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ফেস্টিভালে অংশগ্রহনকারীদের কাজ ঐ চাকতিটি ধরা। পাহাড়ের ঢাল
দিয়ে আছড়ে, গড়িয়ে, ডিগবাজি খেতে খেতে
নিচের দিকে নামতে থাকেন প্রতিযোগীরা। ঢালের নিচে অপেক্ষায় থাকেন একদল স্থানীয়
রাগবি খেলোয়াড়, যারা নিয়ন্ত্রণ হারানো প্রতিযোগীদের ধরে
ফেলেন। থাকে ডাক্তারদের একটি টিমও! এসব করতে গিয়ে অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়।
এমনকি অনেকে মারাও যায়।
হেয়ার ফ্রিজিং ফেস্টিভাল
(কানাডা)
কানাডার হেয়ার ‘ফ্রিজিং ডে’ শুধু অদ্ভুতই নয়, কিছুটা কষ্টদায়কও বটে। এই উৎসবে মাইনাস ৫° থেকে মাইনাস ১০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সুইমিং পুলের
পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। অবশ্য সেটা ঠাণ্ডা নয়, গরম
পানি। শুরুতেই সবাই আরামদায়ক গরম পানিতে ডুব দেয়। এরপর চুলগুলো ভালোমতো ভিজিয়ে
নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যান সবাই। বাকি কাজটা আবহাওয়াই করে দেয়। ভেজা চুল নিয়ে
দাঁড়ানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চুলের পানি জমে বরফ হয়ে যায়। জমে থাকা চুল নিয়েই
যতক্ষণ পারা যায় দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। এরপর বিয়ার আর চকলেট খেয়ে আনন্দে মাতে তারা।
কানাডার তাকহিনি শহরে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব।
বার্নিং ম্যান ফেস্টিভাল
(ইউএস)
১৯৮৬ সালে ল্যারি হার্ভি ও তার বন্ধু জেরি জেমস মিলে স্যান
ফ্রান্সিসকোর বেকার সমুদ্রসৈকতে একটি ৮ ফুট লম্বা কাঠের মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আশেপাশের লোকজন বেশ উৎসাহের সাথে সেটি উপভোগ করে। সেই থেকেই শুরু বার্নিং ম্যান
উৎসব। প্রতি বছর গ্রীষ্মের শেষ দিকে টানা আটদিনের জন্য এই উৎসব পালিত হয় নেভাদার
জনমানবশূন্য ব্ল্যাক রক মরুভূমিতে। জনমানবশূন্য এই মরুভূমি উৎসবের আটদিনে হয়ে ওঠে
মানুষে ভর্তি এক শহরে। ২০১৪ সালে 'বার্নিং ম্যান'
এর মূর্তির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১০৫ ফুট। ২০২৩ সালে এই উৎসবে প্রায়
৭০ হাজার লোক যোগ দিয়েছে। টিকিটের দাম ছিল ৫৭৫ ডলার।
ওয়ার্ম চার্মিং (ইংল্যান্ড)
স্নেক চার্মারদের আমরা বলি সাপুড়ে। তাহলে ওয়ার্ম চার্মারদের
কি বলা উচিত? কেঁচুড়ে? ইংল্যান্ডের ডেভনের ব্ল্যাকঅটন গ্রামে
প্রতিবছর মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় এক বিচিত্র উৎসব, যার নাম ‘ব্ল্যাকঅটনস
ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব ওয়ার্ম চার্মিং’। এই উৎসবে যোগ দিতে হয় টিম নিয়ে।
প্রতিটি দলকে কোনো আবাদযোগ্য জমিতে এক বর্গ মিটার জমি এবং ১৫ মিনিট সময় দেয়া হয়।
এই ১৫ মিনিটে তারা পৃথিবীর যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারবেন, কেবল খুঁড়তে পারবেন না। ১৫ মিনিটে যে দল সবচেয়ে বেশি কেঁচো মাটির উপর
নিয়ে আসতে পারবে, তারাই বিজয়ী।
লা টমাটিনা (স্পেন)
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত
বলিউডের সিনেমা জিন্দেগি না মিলেগি দোবারার কারণে ‘লা টমাটিনা’ বা টমেটো উৎসবের
সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষ বুধবার স্পেনের বুনোল শহরে
মহাসমারোহে উদযাপিত হয় এই উৎসব। উৎসব চলে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক। তবে এই ছোট্ট সময়ের
জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজারো মানুষ। এখানে কোনো
জয়-পরাজয় নেই, কেবল আনন্দ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এজন্য এর নিয়মও বেশ
সহজ। নির্ধারিত স্থানে ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি পাকা টসটসে টমেটো আসবে।
আপনার কাজ কেবল সেগুলো হাতে
নিয়ে চাপ দিয়ে ফাটিয়ে আপনার বন্ধু কিংবা সঙ্গীদের গায়ে ছুঁড়ে মারা। উৎসব শুরুর
কয়েক মিনিটের মাঝেই অংশগ্রহণকারীরা আপাদমস্তক লাল হয়ে যান আর বুনুলের রাস্তায় হয়
টমেটো সসের বন্যা! উৎসবটি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে এখানে যোগ দিতে হলে অন্তত ৩
থেকে ৪ মাস আগে থেকেই আবেদন করতে হয়। কারণ,
বুনোল শহরটি ছোট, খুব বেশি
মানুষ সেখানে আটে না।
কানামারা
মাতসুরি (জাপান)
জাপানের এই উৎসবটি মূলত যৌনতাকে কেন্দ্র করে পালিত হয়।
স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী একসময় এক দৈত্য একজন মহিলার প্রেমে পড়েন। পরবর্তীকালে যখন
সে জানতে পারে সেই মহিলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তখন দৈত্যটি হিংসায়
তার স্বামীর পুরুষাঙ্গ কামড়ে ছিঁড়ে দেন। পরবর্তী কালে স্থানীয় মহিলারা কৃত্রিমভাবে
একটি লোহার পুরুষাঙ্গ তৈরি করেন এবং প্রাচীন বিধি অনুসারে এটিকে পূজা করেন। এই ফেস্টিভালে
ভ্রমণকারীদের পুরুষাঙ্গ আকৃতির খাবার এবং ক্যান্ডিও পরিবেশন করা হয়।
ডে অফ দ্য ডেড (মেক্সিকো)
মৃত মানুষদের উদ্দেশ্যে এই উৎসব পালন করা হয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে জীবিতকালে মানুষ যেমন খাবার এবং ড্রিংকসের সাহায্যে নিজেদের জীবনটাকে উদযাপন করেন, ঠিক সেই ভাবেই মানুষরা তাদের মৃত প্রিয়জনকে স্মরণ করে এই উৎসবের আয়োজন করেন। মেক্সিকোর মানুষদের বিশ্বাস একমাত্র এই দিনেই তাদের মৃত প্রিয়জনরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাই এই দিনে তারা কবরগুলো পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজান। এই উৎসবটি তৈরি হয়েছে অ্যাজটেক এবং ক্যাথলিক কালচারের কম্বিনেশনে।
সান ফার্মিন
(স্পেইন)
ষাঁড়ের সাথে দৌড়ানো প্রতিযোগিতার উৎসব সম্পর্কে আমরা
হয়তো অনেকেই পরিচিত। এটি স্পেনের পাম্পলোনার সামার ফেস্টিভালের একটি অংশ। উৎসবটি
সান ফার্মিন নামে পরিচিত। উৎসবে অংশ নিতে দেশ বিদেশ থেকে আসে হাজারো পর্যটক।
মারাত্মক আহত কিংবা প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকার পরেও মানুষ হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে
স্পেনের পাম্পলোনায় আসে ষাড়ের দৌড়ানি খেতে!