চল্লিশের দশকের একেবারে শেষে ও পঞ্চাশের দশকের গোড়ার সময়টাতে আমেরিকার পারমাণবিক গবেষণাও চলছিল বেশ ধীর গতিতেই। ওদিকে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে, তবে আমেরিকা তখনও যুদ্ধের বাইরে। জার্মানি আর জাপানের অক্ষশক্তির বিপক্ষে লড়ছে মিত্রশক্তির দেশগুলো! তাতে বিশেষ কিছু একটা করার ছিল না মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের। ওদিকে, জার্মানিতে তখন চলছে ইহুদি বিদ্বেষ। ইউরোপের নির্যাতিত অনেক বিজ্ঞানী আশ্রয় নিয়েছেন তার দেশে। তাদেরই মধ্যে একজন হঠাৎ চিঠি লিখে বসল তাকে। চিঠির ভাষ্য এই, জার্মানি পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলার আগেই আপনি তা বানিয়ে ফেলুন। নয়তো হিটলারের হাতে পড়লে এ অস্ত্রের ফল মানবজাতির জন্য হতে পারে ভয়াবহ! চিঠির ওপরে বড় বড় হরফে লেখা “আলবার্ট আইনস্টাইন, ওল্ড গ্রোভ রোড”।
বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চিঠির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। এরপর, ১৯৪১ সালের জুন মাসে রুজভেল্টের নির্দেশে সাইন্টিফিক রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট দফতরের মাধ্যমে “ন্যাশনাল ডিফেন্স রিসার্চ কমিটি” গঠিত হয়। এতদিন দর্শকের ভূমিকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবার নামে যুদ্ধের ময়দানে। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে জাপান আর জার্মানির বিরুদ্ধে। সেইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ ঘটে মার্কিনীদের। আর একইসাথে পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ। মার্কিন প্রশাসন অতি গোপন এক প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। যার নাম দেওয়া হয় “ম্যানহাটন প্রজেক্ট”।
‘পার্ল হারবার’ আক্রমণের পর আর্মির ইঞ্জিনিয়ার ‘কোরে’র সহযোগিতায় সুগঠিত করা হয় ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। অতি গোপনীয় এই প্রকল্পের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ‘লেজলি রিচার্ড গ্রোভ্স’কে।
১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর ধরা দিলো প্রথম বড় সাফল্য। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এনরিকো ফার্মি’ আবিষ্কার করে ফেললেন নিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় শক্তি বিমুক্তিকরণ প্রক্রিয়া। তবে, তিনি যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করতে পেরেছিলেন তার দাড়া শুধুমাত্র একটি বাতি জ্বালানো সম্ভব ছিল! পরিমাণে কম হলেও এটি ছিল নিউক্লীয় শক্তিকে জয় করার প্রথম কার্যকরী ধাপ।
এরপর একদিকে ইউরেনিয়ামের ২৩৫ আইসোটোপ আলাদা করার প্রক্রিয়া অন্যদিকে, ইউরেনিয়ামের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিজ্ঞানী ‘গ্লেন সিবোর্গ’ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্লুটোনিয়ামকে কীভাবে পারমাণবিক বিক্রিয়ক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে। উভয়দিকেই জোর গতিতে এগিয়ে চললো পারমাণবিক গবেষণা। অন্যদিকে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা খুঁজতে থাকলেন এমন এক নিরাপদ স্থান যেখানে কোনরকম ক্ষতি ছাড়াই চালানো যাবে পরীক্ষা। আর সরকারি অনুদানে পূর্বেই ফুলে ফেঁপে ওঠে তহবিল। তাই, গবেষণায় অর্থসংক্রান্ত কোনো সমস্যারই উদ্রেক ঘটেনি। ফলে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে পরমাণু কর্মসূচি।
এরমধ্যেই, ১৯৪৩ সালে থিওরিটিক্যাল
পদার্থবিদ রবার্ট ওপেনহাইমারকে লস অ্যালামসে পরীক্ষাগারের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় পরীক্ষাগারটিকে পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট Y। এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় দেড় বছর পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখা পায় প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের! তবে, শুধু বানালেই তো হবে না। সেটা কাজও করতে হবে ঠিকঠাক ভাবে। তাই, সফলভাবে এর পরীক্ষাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই, আর কালক্ষেপণ না করে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রকে প্রস্তুত করা হয় পরীক্ষার জন্য। প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট "ট্রিনিটি"। নিউ মেক্সিকোর অ্যালামোগোরডের কাছে মরুভূমিতে অবস্থিত মার্কিন বিমান বাহিনীর বেসকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে অনুমোদন করেন জেনারেল লেসলি গ্রোভস।
একটি ইস্পাত টাওয়ারের উপর থেকে বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে জড়িত বিজ্ঞানী, সেনাসদস্যরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মার্কিন বিমান ঘাঁটির দিকে। সফল কি হবে তাদের এতদিনের পরিশ্রম? অবশেষে এলো সে মহেন্দ্রক্ষণ। ২১ হাজার টন টি.এন.টি বিস্ফোরকের সমতুল্য বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা সফলভাবে বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তেই প্রচণ্ড তাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ইস্পাতের টাওয়ারটি। এক অশরীরী আলোর ঝলকানিতে বন্ধ হয়ে গেলো সকলের চোখ। পরমুহূর্তেই, মনে হল যেন আগুনের একটি বিশাল বল আকাশ ফুঁড়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, সেইসাথে ৪০ হাজার ফুট মাশরুমের মতো মেঘে ছেয়ে গেছে চারপাশ। অবাক চোখে তাকিয়ে মানবজাতির গুটিকয়েক সদস্য সেদিন সাক্ষী হলেন এক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের! বিস্ময় আর আতংকে মানবজাতি দেখলো তার বিনাশের হাতিয়ার আজ চলে এসেছে তাদের হাতে!
এরপরের ইতিহাসটা সবারই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অত্যধিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে জার্মানী আত্মসমর্পণে রাজি হয়। অন্যদিকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না জাপানকে। আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায় তারা। অন্যদিকে আবার পার্ল হারবারের হামলার একটা ক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের ছিলই। তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমার শিকারে পরিণত হয় জাপান। ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা নগরীতে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা 'লিটল বয়'! মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় শহরটি। এর তিনদিন পর ৯ আগস্ট, নাগাসাকি শহরের ওপর নেমে আসে পৃথিবীর তৃতীয় পারমাণবিক বোমা 'ফ্যাটম্যান'! এই দুই হামলায় প্রায় ১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। সেইসাথে কতজন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে যান তার ইয়াত্তা নেই। তেজস্ক্রিয়তার কারণে শতবছরের জন্য পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে শহরদুটি।
১০ আগস্ট জাপান ওয়াশিংটনে আত্মসমর্পণের খবর পাঠায়। ১৪ আগস্ট তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ইতি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। তবে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সুসংবাদের সাথে সাথে মানবজাতির উপর নেমে আসে এক বড় অভিশাপ! পারমাণবিক অস্ত্রের অভিশাপ। মানুষ সন্ধান পেয়ে যায় নিজেকে ধ্বংসের হাতিয়ারের। হুমকির মুখে পড়ে যায় পুরো মানবসভ্যতা!