ইনকা সভ্যতার হারানো সোনার শহর পাইতিতি | Discovery of Paititi | Lost City of Gold

Author
0

 


এল ডোরাডো। দ্য লস্ট সিটি অফ জেড। হারিয়ে যাওয়া সোনার শহর বলতে আমরা মূলত এই দুটোই বুঝি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না যে, ইনকাদেরও একটি সোনার শহর ছিল। যার নাম ছিল পাইতিতি। সোনায় ভরা শহর নিয়ে ইনকা সভ্যতার যত গল্প রয়েছে, তা বোধ হয় আর কোনো সভ্যতার নেই। যুগ যুগ ধরে লোকমুখে চলে আসা সেই অনন্য শহরের খোঁজ চলছে তো চলছেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি এর। ইনকাদের শেষ উত্তরসূরি ছিল কেচুয়ান গোষ্ঠী। পাইতিতির ইতিহাস সবটাই লোকমুখে শোনা। গবেষকদের মতে ইনকা বীর ইনকারির হাতে প্রতিষ্ঠা পায় পাইতিতি। স্পেন-ইনকার মধ্যকার যুদ্ধ প্রায় ৪০ বছর ধরে চলেছিল এবং যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে ১৫৭২ সালে ইনকা সাম্রাজ্য স্প্যানিশদের দখলে চলে যায়।


পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন



স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতার রাজধানী কুস্কোতে প্রবেশ করে লুটপাট চালালে স্প্যানিশদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ইনকারা তাদের ধনসম্পদ ও সোনাদানা কোনো এক অজানা জায়গায় লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশদের আক্রমণের সময় আন্দিজের পূর্ব অঞ্চলে ইনকারা আশ্রয় নেয় এবং এটাই হয়তো তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। পাইতিতির সন্ধানে অভিযান শুরু হয়েছে অনেককাল আগে থেকেই। অনেকেই এই পাইতিতি খুঁজতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউ নিখোঁজ রয়েছেন আজও, কেউ ব্যর্থ হয়েছেন, কেউ কেউ আবার শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন আমাজনের অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে লুকিয়ে আছে পাইতিতি। এই পাইতিতি আবিষ্কারের অজানা কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল লিখেছিলেন ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’। বইটির জনপ্রিয়তা আজো আছে পাঠকসমাজে।

১৯৭৯ সালে দুজন ফ্রেঞ্চ-পেরুভিয়ান অভিযাত্রী নিকোলা এবং হার্বার্ট কার্টেজেনা ম্যামেরিয়ার এগ্রেরিয়ান সেটেলমেন্ট খুঁজে পান। তাদের এই আবিষ্কার পেরুভিয়ান আমাজন জঙ্গলে ইনকার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম লিখিত প্রমান। ম্যামেরিয়া আনুমানিক ১৫ বর্গমিটারের ঘরবাড়ি নিয়ে গঠিত ইনকা সভ্যতার পিরকা স্টাইলে। তবে গবেষকরা এখানেই থেমে যাননি। ২০০১ সালে, ইতালিয়ান আর্কিওলজিস্ট মারিও পোলিও, আন্দ্রেজ লোপেজ নামক একজন মিশনারীর একটি রিপোর্ট আবিষ্কার করেন ভ্যাটিকান আর্কাইভ থেকে। ১৬০০ সালের ঘটনা সম্বলিত এই রিপোর্টটিতে লোপেজ বিস্তারিত অনেক কিছুই লিখেছেন। একটি বিশাল শহর যা সোনা, রূপা ও অন্যান্য রত্নসমৃদ্ধ, যা স্থানীয়দের কাছে পাইতিতি নামে পরিচিত। এটির অবস্থান ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলের মাঝখানে।

লোপেজ ভ্যাটিকান পোপ ত্রয়োদশ কোমেটকে এই রিপোর্ট সম্পর্কে জানান এবং ভ্যাটিকান অনেক বছর এর অবস্থান গোপন করে রাখে। কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন ভ্যাটিকান সিটির উচ্চপদস্থ লোকেরা জানেন পাইতিতির অবস্থান এবং তারা এখনো সেগুলোকে পৃথিবীর কাছ থেকে গোপন করে রেখেছেন।

২০০১ সালে লোপেজের কাজটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেও অনেক অভিযাত্রী এবং আর্কিওলজিস্ট অনেক সময় এবং রিসোর্স ব্যয় করেছে আমাজনের হারানো এই এলাকা খুঁজে বের করার জন্য। ১৫ শতকের দিকে ইনকার প্রাণকেন্দ্র কুস্কো সম্পর্কে সম্পর্কে সবকিছু জেনে পিযারো ও তার দলও যাত্রা শুরু করেছিল

আন্দ্রেজ লোপেজের উল্লেখ করা সোনার শহর কুস্কো, যার মন্দিরের দেয়ালগুলো প্রায় ৭০০ এরও বেশি সোনার শীট দিয়ে মোড়ানো যেগুলোর প্রত্যেকটি ২ কিলোগ্রাম ওজনের বেশি ছিল। পিযারো ও তার দলবলের আরো অবাক হওয়া বাকি ছিল। ইনকাদের সৃষ্টিকর্তা সূর্যকে উৎসর্গ করে কুস্কোতে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এই মন্দিরে প্রচুর পরিমাণে কঠিন সোনার ডিস্কসহ মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় যেগুলো ইনকা প্রভুর নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু রহস্যময়ভাবে এগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে। পিযারোর দল আরো কিছু উল্লেখযোগ্য মূল্যবান প্রত্নতত্ত্বের খোঁজ পান যার মধ্যে ১৪টি গোল্ড ক্ল্যাড মমির উল্লেখ আছে। এই মমিগুলো ইনকা রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের ছিল, কিন্তু এর সবগুলোই পিযারোর কুস্কোতে পৌঁছার পূর্বেই হারিয়ে যায়।



ইনকার খোঁজে বের হওয়া অভিযাত্রীদের আরো একজন পার্সি হ্যারিসন ফচেট। ১৯২৫ সালে ফচেট ব্রাজিলের দিককার আমাজন বনে যাত্রা শুরু করেন একটি হারানো শহরের উদ্দেশ্যে যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য লস্ট সিটি অফ জেড’। যদিও এটা সরাসরি ইনকা সভ্যতা খোঁজার ঘটনা নয় তবে এটি অন্য অভিযাত্রীদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় পাইতিতির মতো শহর খুঁজে পাওয়ার। ফচেটের এই কাহিনী নিয়ে পরে হলিউডে ‘দ্য লস্ট সিটি অফ জেড’ নামক সিনেমাও তৈরি হয়। অন্যান্য গবেষক-এর মধ্যে ছিলেন কার্টেজেনাস যিনি ম্যামেরিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিও বিংশ শতাব্দীতে ইনকা সভ্যতা খুঁজে বেড়িয়েছেন। হিটলারের চিত্রগ্রাহক হ্যান্স এর্তল থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বজুড়ে অসংখ্য অভিযাত্রী এই ইনকা সভ্যতার খোঁজে বেড়িয়েছিলেন। তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন রহস্যময় আমাজনের গহীনে, কারোর বা মৃত্যুও হয়েছে।

তবে এখনো নিশ্চিতভাবে পাইতিতির অস্তিত্ব ও হারানো সোনার সন্ধানের জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিংবদন্তী অভিযাত্রী গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান বিশ্বাস করেন খুব শীঘ্রই তিনি খুঁজে পাবেন পাইতিতি, হারিয়ে যাওয়া সেই সোনাসমৃদ্ধ শহরটিকে পাইতিতি আবিষ্কারের এই অভিযান এখনো অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। পাইতিতির আবিষ্কার আমাদেরকে ইনকা সভ্যতা ও তার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে ও বুঝতে সাহায্য করবে। এই জায়গাটি এবং এখানে থাকা প্রত্নতত্ত্বগুলো খুঁজে পাওয়া গেলে ইনকাদের সভ্যতার অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত হবে, টিকিয়ে রাখা যাবে হারিয়ে যাওয়া ইনকাদের স্মৃতি৷ জানা যাবে পাইতিতি কি শুধুই মিথ নাকি সত্যি!

মতামত

0Comments

আপনার মতামত লিখুন (0)

#buttons=(ঠিক আছে!) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটি ব্যবহারে আপনার অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য কুকিজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমরা কখনই আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার কোনো ডাটা সংরক্ষণ করব না। আরো জানুন
Ok, Go it!