ধরুন আপনি নতুন একটি দেশে ট্যুরে গেলেন। রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছেন। চারপাশের বাড়িঘর, মানুষজন সবই আপনার অচেনা। হঠাৎ করে একটি বিড়াল দেখে আপনার মনে হলো আপনি সেই বিড়ালটিকে আগেও দেখেছেন। খুব চেনা চেনা লাগছে। অথচ আপনি সেই এলাকায় আগে কখনো যান ই নি, বিড়ালটিকে দেখা তো পরের কথা। আমাদের হুট করে কোনো কিছু এরকম চেনা চেনা মনে হওয়াকেই সায়েন্সের ভাষায় ‘ডেজা ভ্যু' বলা হয়। আমাদের সবার সাথেই কম-বেশি এই বিষয়টি ঘটে থাকে।
ডেজা ভ্যু শব্দটি মূলত ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে এসেছে, যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘যা ইতিমধ্যেই দেখা হয়েছে’। এর অন্য আরেকটি নাম পারামনেসিয়া, যা মূলত গ্রিক শব্দ ‘প্রোমনেসিয়’ থেকে এসেছে। দেজা ভ্যু নামটি প্রচলিত হবার বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যিক ও সাইকোলজিস্টের লেখায় এই ধরনের পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া গেছে। কিন্তু তখন পুরো বিষয়টি এককথায় প্রকাশ করার জন্য কোনো নাম ছিল না। ফ্রেঞ্চ সাইকোলজি অ্যানালিস্ট এমিল বোইরেক সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মানসিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নামক একটি বই লিখেন। বইটির একটি আর্টিকেলে তিনি ডেজা ভ্যু শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে দুনিয়ার প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ কম বেশি এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
নাম্বার ওয়ান – অ্যাটেনশনাল
ধরে নেওয়া যাক আপনি একটা কাজ করতে গেলেন, ঠিক সেই সময় পাশ থেকে আসা একটি
আওয়াজে সেদিকে আপনার চোখ গেল। হুট করে আপনার মনে হলো আরে এরকম তো আগেও ঘটেছে আমার সাথে!
এটাই অ্যাটেনশনাল ডেজা ভ্যু।
নাম্বার
টু – মেমোরি
অনেক সময় কোনো ঘটনা বা দেখা জিনিসের একটা অংশ খুব চেনা চেনা লাগে। কিন্তু
কোনোভাবেই পুরো ঘটনা মনে আসে না। এটাই মেমোরি ডেজা ভ্যু।
নাম্বার থ্রি – ডুয়েল
প্রসেসিং
অনেক সময় মনে হয় যে কোন একটা কিছু চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু একই সাথে কোন
জিনিস বা ঘটনাটি চেনা চেনা লাগছে সেটা মনে আসে না। সেটাকেই বলে ডুয়েল প্রসেসিং ডেজা
ভ্যু।
নাম্বার ফোর – নিউরোলজিকাল
স্নায়ুকোষ কাজ না করায় আমাদের ইন্দ্রিয় গুলোর উলটাপালটা রিঅ্যাকশনের কারণে
অনেক সময় আমরা ডেজা ভ্যু অনুভব করি। এই ধরণের ডেজা ভ্যুকে বলে নিউরোলজিকাল ডেজা ভ্যু।
ডেজা ভ্যু কেন হয়?
দেজা ভ্যু হওয়ার আসল কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত হতে পারেন নি।
একেকজন একেকরকম কারণ দেখিয়েছেন। চলুন তেমনই কয়েকটি দেখে আসা যাক।
স্বপ্ন থিওরি
কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, মানুষের ডেজা ভ্যু হয়
যে জিনিসটি নিয়ে সেটি সে আগেই স্বপ্নে দেখে। কিন্তু মানুষ খুব কম স্বপ্নই মনে রাখতে
পারে। আর তাই সকালে উঠে সেই স্বপ্নটি আর তার মনে থাকে না কিন্তু সাবকনশাস মাইন্ডে ঠিকই
সেই স্বপ্নটি থেকে যায়। পরে যখন সে বাস্তবে সেই ঘটনা দেখে তখন তার সাবকনশাস মাইন্ড
সেই স্বপ্নে দেখা মেমোরিকে মনে করিয়ে দেয়। তখনই তার মনে হয় যে ওই জিনিসটি সে আগেই
দেখেছে।
মেমোরি থিওরি
এখন যে ব্যাখ্যার কথা বলব সেটি মেমোরির সাথে সম্পর্কিত। এই থিওরি অনুযায়ী ডেজা ভ্যু হওয়া ঘটনা আগেও মানুষ দেখে। কিন্তু অনেক আগে তা দেখার কারণে মেমোরিতে পুরোপুরিভাবে থাকে না। কিন্তু সাবকনশাস মাইন্ডে তার একটা ছাপ থেকে যায়। এর ফলে যখন আবারও সেই ঘটনা ঘটে তখন স্মৃতির গভীর থেকে ওই পুরনো স্মৃতিও তার সামনে চলে আসে। তখন তার মনে হয় এই ঘটনাটি আগেও ঘটেছে।
ডেজা
ভ্যু নিয়ে করা বিখ্যাত গবেষণা
রিসার্চ
অফ অ্যানি ক্লেরি
কলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট অ্যানি ক্লেরি অনেকদিন ধরে ডেজা
ভ্যু নিয়ে রিসার্চ করেছেন। তার মতে,
ডেজা ভ্যু আগের কোনো মেমোরির কারণেই ঘটে। এটা আমাদের অনুভূতির সাথে জড়িত। কারো স্বাভাবিক অনুমানের থেকে ডেজা ভ্যু হওয়া কোনো ব্যক্তি কম্পারেটিভলি ঠিকভাবে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা করতে পারেন। অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীই বিভিন্ন সময়ে দেজা ভ্যুর সাথে মনের একটা সম্পর্কের কথা বলেছেন। কিন্তু ক্লেরি সেটি রিজেক্ট করে দিয়েছেন।
১৯৫৯ সালের এক রিসার্চে বলা হয়, ডেজা ভ্যুর কারণ হচ্ছে আমাদের ব্রেইনের আউটার পার্টের সাময়িক একটি উদ্দীপনা। এই পর্যবেক্ষণের উপরে ভিত্তি করে ক্লেরি ২৯৮ জন ব্যক্তির উপরে এক পরীক্ষা চালান। তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে একই কম্পিউটার গেম খেলতে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার রেজাল্ট ডেজা ভ্যু সম্পর্কে আগের প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে অস্বীকার করে। ক্লেরি নতুন করে বলেন, “ডেজা ভ্যুর অভিজ্ঞতা কখনোই ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা দেয় না।”
রিসার্চ
অফ আকিরা ও’কনর
রিসেন্টলি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চার আকিরা ও’কনরের এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আকিরার রিসার্চে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকটি শব্দ পড়তে দেয়া হয়। শব্দগুলো ছিল- বিছানা, বালিশ, রাত, স্বপ্ন ইত্যাদি। এই শব্দগুলো ঘুমের সাথে রিলেটেড হলেও ঘুম শব্দটি তাদের পড়তে দেওয়া হয় নি। কিন্তু যখন পরবর্তীতে শব্দগুলো বলতে বলা হলো, তখন তাদের মধ্যে একটি উত্তেজনা তৈরি করা হয় যাতে তারা ‘ঘুম’ শব্দটি শুনেছেন বলে মনে করেন। কৌশলটি ছিল একটি ‘মিথ্যা মেমোরি তৈরি করার চেষ্টা’, কিন্তু সেটি তাদের সাথে ঘটেনি।
এই রিসার্চের রেজাল্টের ভিত্তিতে আকিরা ও’কনর বলেন, “দেজা ভ্যু এক্সপেরিয়েন্স করার সাথে আসলে পুরনো কোনো মেমোরির কানেকশন নেই।”