বহু শতাব্দী আগের এক গভীর অন্ধকার রাত। জেলখানার ভেতরের একটি
কক্ষ থেকে পাওয়া যাচ্ছে খসখস আওয়াজ। কেউ কাগজে কিছু একটা লিখছে। সারারাত ধরে পাওয়া
গেলো সেই শব্দ। শোনা যায় সেই সেলে ছিল সাজাপ্রাপ্ত এক সন্ন্যাসী। কিন্তু সূর্য ওঠার
পরে সেখানে গিয়ে পাওয়া গেলো না কাউকে। সেলের ভেতরে পড়ে আছে বিশাল আকৃতির একটি বই।
বইটির যা সাইজ, এক রাতে সেই বই লেখা কোনও মানুষের দ্বারা সম্ভব না। ধারণা করা হয়
সেটি লিখেছে স্বয়ং শয়তান। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, বইয়ের ভিতরে
ইবলিশ নিজেই নাকি এঁকে গিয়েছে নিজের স্কেচ! যা দেখলে আজও শিউরে ওঠে মানুষ।
ইতিহাসের অনন্য বিস্ময় এই বইটি। যার নাম ‘কোডেক্স গিগাস’। ইতিহাস জুড়ে নানা হাত
ঘুরে আজ সুইডেনের জাতীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩১০ পাতার বিশাল সেই ডেভিলস বাইবেল।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
https://youtu.be/qPvRW1zbD6A?si=hWtT-TnUvYrRgyaF
কোডেক্স গিগাস
নামের কারণ
এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করা পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে সবথেকে বড় এই কোডেক্স গিগাস। ‘কোডেক্স গিগাস’ শব্দের অর্থ বিশাল কোন বই। এর দ্বারা বইটির বিশালতা বোঝানো হয়েছে। বইটি দেখতে যেমন বড়, তেমনি ওজনেও ভারি। বইটিতে গাধার চামড়া দিয়ে তৈরি মোট ৩১০টি পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ প্রায় ২০ ইঞ্চি। ১৬৫ পাউণ্ডের ভারি এই বইটি প্রায় ৮.৭ ইঞ্চি মোটা। যা কারো একার পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। বইটির শেষদিকের অনেকগুলো পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায় নি। ইতিহাসবিদদের মতে, ইচ্ছাকৃতভাবে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ঠিক কী কারণে একে শয়তানের বাইবেল বলা হয়? এর পেছনের গল্পটা কী? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই সন্ন্যাসীর গল্পে। চোখ মেলে তাকাতে হবে আরেকটু পেছনে।
প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের কোনো এক রাজার আমলের কথা। সময়টা তখন ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। রাজ্যের এক সন্ন্যাসী খুব গুরুতর অন্যায় করে বসে। তাকে রাজার কাছে আনা হলো বিচারের জন্য। রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। কিন্তু সন্ন্যাসী রাজার কাছে আর্জি করলেন, তাকে যেন শেষবারের মতো একটি সুযোগ দেয়া হয়। বিনিময়ে তিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান একসাথে করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেবেন। রাজা তার প্রস্তাবে রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু তাকে সময় দিলেন মাত্র একরাত। সন্ন্যাসী রাজি হয়ে গেলেন। তিনি লেগে পড়লেন কাজে। কিন্তু টানা লেখার পরেও সেই পাণ্ডুলিপি শেষ করা সম্ভব হলো না। শেষপর্যন্ত সেই সন্ন্যাসী লুসিফার অর্থাৎ ইবলিশের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। লুসিফার তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। বিনিময়ে সন্ন্যাসী নিজের আত্মা উৎসর্গ করে দিলেন লুসিফারের কাছে। লুসিফার এক মুহূর্তের মধ্যে সেই পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করে দিল। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পূর্বে রেখে গেলেন তার স্বাক্ষর। পাণ্ডুলিপির ২০৯ পৃষ্ঠায় লুসিফারের ভয়ংকর একটি স্কেচের পাশে দেওয়া আছে সেই স্বাক্ষরটি। তার ঠিক বিপরীত পৃষ্ঠায় আঁকা হয়েছে জেরুজালেমের ছবি। সেই ছবির কারণে এর নাম হয়ে গেল ‘শয়তানের বাইবেল’। তখনকার যুগে কিন্তু কোন আর্টওয়ার্কে শয়তানের স্কেচের ব্যবহার দেখা যেত মাঝে মাঝেই। কিন্তু এই পাণ্ডুলিপির শয়তানের স্কেচটি ছিল একটু আলাদা ধাঁচের। এখানে শয়তান ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন!
কোডেক্স গিগাসের
ইতিহাস
১৫৯৪ সাল পর্যন্ত এটি চেক প্রজাতন্ত্রের শহর শ্রুদিমের
একটি মিউজিয়ামে রাখা ছিল। এরপর রাজা দ্বিতীয় রুডলফ সেখান থেকে বইটি ধার নেন।
বলেছিলেন পড়া হলে ফেরত দেবেন। কিন্তু আমরা সকলেই জানি, বই ধার নিলে সহজে কেউ ফেরত
দেয় না। তিনি প্রাগ শহরে নিয়ে আসেন সেই বাইবেলখানা। তিনিও বাকি সবার মতো সেটি ফেরত
দিতে ভুলে যান।
১৬৪৮ সালে যুদ্ধ শেষে সুইস সোলজারদের হাতে পড়ে সেটি। তারা নিয়ে আসেন স্টকহোমে। রাখা হয় Royal Library
of Stockholm-এ। এরপর সেটি সুইস গবেষকদের নজরে আসে। তাদের
রিসার্চের পরেই বের হয়ে আসে এর রোমাঞ্চকর ইতিহাস। ২০০৭ সালে আবারও প্রাগে ফিরিয়ে
নেওয়া হয় পাণ্ডুলিপিটি। প্রথমদিকে জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হলেও,
এখন আর সেই সুযোগ নেই।
কোডেক্স গিগাসের
ভেতরে আসলে কি কি লেখা আছে?
কন্টেন্টের কথা চিন্তা করলে, কোডেক্স গিগাস মধ্যযুগের
সময়কার একটি জ্বলজ্যান্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। পুরো বাইবেলটি লেখা হয়েছে ল্যাটিন
ভাষায়। পাণ্ডুলিপির শুরুতে পবিত্র ওল্ড টেস্টামেন্ট অ্যাড করা আছে। এছাড়াও ফ্লেভিয়াস
জোসেফাস নামক এক পণ্ডিতের লেখা The Jewish War and Jewish Antiquities, সেইন্ট ইসিডোরের লেখা একটি Encyclopedia, প্রিস্ট
কোমাকের লেখা The Chronicle of Bohemia ও বাইবেলের নতুন
টেস্টামেন্টও অ্যাটাচ করা আছে এটির সাথে।
এবারে দেখে আসা যাক বাইবেলটি ঘেঁটে ইতিহাসবিদদের বের করা কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য। পুরো পাণ্ডুলিপিতে মাত্র দুটি ছবি আঁকা হয়েছে - নরকের রাজপুত্র লুসিফার ও জেরুজালেম শহর। ছবিতে লুসিফারকে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকা অবস্থায় আঁকা হয়েছে। তাই হঠাৎ করে তাকালে মনে হবে এই বুঝি লুসিফার বই থেকে বের হয়ে ঝাঁপ দেবে। বইয়ের একটি পাতায় চোর ধরার জন্য দুটি জাদুমন্ত্র লিখে রেখেছেন শয়তান। চোর ধরতে আগ্রহী পাঠকরা সেটি লুফে নিতে পারেন। তবে তার আগে অবশ্যই তাকে ল্যাটিন ভাষা জানতে হবে। শয়তানের আছর থেকে মুক্তি পেতে খুবই অদ্ভুত কয়েকটি রিচুয়ালের কথা বলা হয়েছে বইটিতে।