এক সিজন আগেই যেই দলটা ধুঁকছিল রেলিগেশন ব্যাটেলে, তারাই পরের
সিজনে রীতিমত টপ ফোরে থেকে কোয়ালিফাই করলো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে! বলেন তো দেখি কাদের কথা
বলছি? হ্যা, ঠিকই ধরেছেন। বলছি সৌদি মালিকানাধীন ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডের কথা।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এতদিন ফুটবল ক্লাবগুলোর মালিকদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির ওউনার শেখ মানসুর। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড। কিন্তু এখন আর ক্লাব ওউনারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী তিনি নন। এমনকি তার কিংবা অন্য কারো সবচেয়ে ধনী ক্লাব ওউনারের ধারে-কাছেও অবস্থান নেই। রিচেস্ট ক্লাব ওউনার এখন সৌদির বাদশাহ সালমান। তার ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ এর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড! অর্থাৎ হিসেবে নিউক্যাসল ইউনাইটেড এখন ম্যান সিটির থেকেও ২৮ গুণ বেশি রিচ ক্লাব। যাই হোক, নিউক্যাসল ইউনাইটেড বাদশাহ সালমানের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের মালিকানায় আসে ২০২১/২২ সিজনের মাঝপথে। মালিকানায় রদবদলের আগে পয়েন্ট টেবিলে নিউক্যাসলের অবস্থান ছিল ১৯ নম্বরে। অর্থাৎ শেষ থেকে দুই নম্বরে! দলের অবস্থা যাচ্ছেতাই। সবাই ভেবেই নিয়েছিলো মালিকানার প্রথম সিজনেই রেলিগেটেড হয়ে যাবে ম্যাগপাইরা।
ঠিক সেই সময়েই বাজিমাতটা করে ক্লাব কর্মকর্তারা। না, পিএসজি
কিংবা চেলসির মতো ট্রান্সফার মার্কেটে হিউজ অ্যামাউন্টের টাকা ঢালার পাগলামি তারা করে
নি। আসল বাজিটা খেলে তারা তরুণ ইংলিশ ম্যানেজার এডি হাউকে অ্যাপয়েন্ট করে। কেউ ধারণাও
করতে পারে নি যে, এডি হাউ এসেই রীতিমত ভোজবাজীর মতো পালটে দেবে ম্যাগপাইদের।
গেইমউইক ১১ এর পরে দায়িত্বে আসেন এডি হাউ। দলের এমনই নাজুক অবস্থা ছিল যে সিজনের মাঝামাঝি অর্থাৎ জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোর আগ পর্যন্ত তাদের অবস্থান পয়েন্ট টেবিলের ১৯ নম্বরেই অনড় থাকে। এডি হাউ আসল বাজিমাতটা করেন সেই ট্রান্সফার উইন্ডোতেই। সেই উইন্ডোতে টোটাল পাঁচটি সাইনিং করেন তিনি। প্রথমেই মাত্র ১২ মিলিয়ন পাউন্ডে দলে আনেন কিয়েরান ট্রিপিয়ারকে। যিনি এখন নিউক্যাসলের ক্যাপ্টেন। গত সিজনে ওয়ার্ল্ড ফুটবলেরই বেস্ট রাইটব্যাক ছিলেন তিনি। এছাড়াও দলে আনেন বর্তমান দলের কোর মেম্বার ব্রুনো গুইমারায়েস এবং ড্যান বার্নকে। দুজনেই গত সিজনে তাদের ক্যারিয়ারের বেস্ট সিজন কাটিয়েছেন। দুজনকে আনতে এডি হাউ খরচ করেছিলেন মাত্র ৫৩ মিলিয়ন পাউন্ড। এডি হাউ আরো একটি বাজি খেলেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার জোয়েলিন্টনকে মিডফিল্ডারে রূপান্তরিত করে। স্ট্রাইকার হিসেবে এসে সুপার ফ্লপ হওয়া জোয়েলিন্টন মিডফিল্ডে শিফট হয়ে রীতিমত ফাটিয়ে ফেলেন। তার ফিজিকালিটি এবং পেইসকে দারুণভাবে কাজে লাগান এডি হাউ।
এই পরিবর্তনগুলোর ফলে দল আমূলে বদলে যায়। সিজনের পরের হাফে ২০ ম্যাচ খেলে নিউক্যাসল হারে মাত্র পাঁচটিতে। এই পাঁচ দলের চারটি ছিল সিটি, লিভারপুল, স্পার্স এবং চেলসি। ম্যাগপাইরা ড্র করে তিনটি ম্যাচ এবং জিতে নেয় ১২ টি ম্যাচ। হাফ সিজন পর্যন্ত রেলিগেশন জোনে ধুঁকতে থাকা দলটাই সিজন শেষ করে পয়েন্ট টেবিলের মাঝখানে ১১ নম্বরে থেকে। পরের সিজনে অর্থাৎ ২২-২৩ সিজনে সবার চোখ কপালে তুলে ফেলার মতো কাজটি করে এডি হাউয়ের নিউক্যাসল ইউনাইটেড।
আগের সিজনে লোনে আনা ম্যাট টার্গেটকে তারা এই সিজনে অ্যাস্টন ভিলা থেকে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডে পার্মানেন্টলি কিনে নেয়। যদিও এই ট্রান্সফারটি শেষ পর্যন্ত ক্লিক করে নি। তবে সেবারের সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ট্রান্সফার করেন এডি হাউ। টোটাল ১০৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে দলে আনেন নিক পোপ, Sven বটম্যান (নট ব্যাটম্যান) এবং আলেক্সান্দার ইসাককে। এই তিনজনই এখন এডি হাউয়ের সিস্টেমের কোর মেম্বার। তিনজনই দুর্দান্ত পারফর্ম করেন সিজনে। নিক পোপ তো সম্পূর্ণ লিগেই অন্যতম সেরা গোলকিপার ছিলেন। সিজনজুড়ে সর্বনিম্ন মাত্র পাঁচটি ম্যাচ হারে তারা। সবচেয়ে কম ৩৩ টি গোল খাওয়ার রেকর্ডটিও সিটির সাথে যৌথভাবে ছিল তাদের দখলে। এই সিজনে তাদের ডিফেন্স ছিল রীতিমত চীনের প্রাচীর। ৭১ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবিলের চার নম্বরে থেকে সিজন শেষ করে ম্যাগপাইরা। ২১ বছর পর জায়গা করে নেয় ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ স্টেজে। ইভেন এটাই তাদের ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম ডিরেক্ট কোয়ালিফিকেশন। কারাবাও কাপের ফাইনালও খেলে তারা। এর আগে শেষ কোন ডমেস্টিক কাপ ফাইনাল খেলেছিল তারা ২৩ বছর আগে। ফুটবল এক্সপার্ট এবং ভক্তরা এখন নিউক্যাসলকে ইংলিশ ফুটবলের প্রিমিয়াম ক্লাবগুলোর মধ্যেও জায়গা দিচ্ছে। ‘টপ সিক্স’ কে এক্সটেন্ট করে সবাই এখন ‘টপ সেভেন’ ডাকছে। সেই লিস্টে লিভারপুল, ম্যান ইউনাইটেড, আর্সেনাল, ম্যান সিটি, চেলসি এবং টটেনহামের পরে নতুন সদস্য হিসেবে স্থান পেল নিউক্যাসল ইউনাইটেড।
এতকিছুর পেছনে সৌদি রিয়ালের থেকেও বেশি অবদান দিতে হয় ক্লাব
কর্মকর্তা এবং ম্যানেজার এডি হাউয়ের স্মার্টলি এবং দক্ষহাতে দল পরিচালনা করার গুণকে।
এডি হাওকে ট্রান্সফার মার্কেটে স্মার্টলি টাকা খরচ করে দলের সিস্টেমের উপযোগী ফুটবলার
কিনে আনার জন্যেও ক্রেডিট দিতেই হয়। এই উইন্ডোতেও তার প্রমাণ রেখে চলেছেন তিনি।
আর্সেনাল, চেলসিরা যেখানে ১০০ মিলিয়ন ক্রস করে এঞ্জো, রাইস, কাইসেডোদের দলে ভেড়াচ্ছেন, এডি হাউ সেখানে মাত্র ৫৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে এসি মিলান থেকে দারুণ প্রতিভাবান ইতালিয়ান মিডফিল্ডার সান্দ্রো টোনালিকে কিনেছেন। এছাড়াও তারা দলে ভিড়িয়েছেন হার্ভি বার্নস, টিনো লিভ্রামেন্টো ও লুইস হলের মতো ট্যালেন্টেড ইয়াং প্লেয়ার।