ফুটবলে সবথেকে বড় রাইভাল
কারা? নিশ্চিতভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ও রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা। ক্লাব ফুটবলে
প্রত্যেক লিগেই এরকম রাইভালরি আছে। অনেক সময় এই রাইভালরি চলে যায়
মারামারি-হাতাহাতির পর্যায়েও। আজকের আয়োজন তেমনি চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু রাইভালরি
নিয়ে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
- মিলান ডার্বি: এসি মিলান বনাম ইন্টার মিলান
ইতালিয়ান লিগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব
ইন্টার মিলান ও এসি মিলানকে নিয়ে হওয়া এই ডার্বির উত্তেজনা ছুঁয়ে যায় পুরো
বিশ্বজুড়ে। সিরি আ’র অন্যতম সফল এই দুই দল মিলে নিজেদের ট্রফি ক্যাবিনেটে সর্বমোট
৩৬টি স্কুদেত্তো ও ১০ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি যোগ করেছে।
১৯০৮ সালে এসি মিলানই মিলান শহরের প্রতিনিধি
হিসেবে ইতালিয়ান লিগে খেলা শুরু করে। কিন্তু বিদেশি খেলোয়াড়ের চুক্তি নিয়ে
অভ্যন্তরীণ ঝামেলায় ক্লাবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই থেকেই জন্ম হয় ইন্টার
মিলানের। দুই দলের স্টেডিয়াম এক হওয়াতে খেলার উত্তেজনার পারদও থাকে তুঙ্গে।
বিশেষ করে ‘৬০ এর দশকে মিলান ডার্বি নিয়ে
উত্তেজনা ছিলো চোখে পড়ার মতো। দুই দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২২২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত
হয়েছে। তার মধ্যে ইন্টার মিলান জিতেছে ৭৯টি এবং এসি মিলান ৬৭টি।
দুই ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও
বেশ কিছু খেলোয়াড় খেলেছেন দুই ক্লাবের হয়েই। তাদের মধ্যে রবার্তো ব্যাজ্জিও, প্যাট্রিক ভিয়েরা, লিওনার্দো বনুচ্চি, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ক্লারেন্স সিডর্ফ,
আন্দ্রেয়া পিরলো, রোনালদো নাজারিও, হাকান
চালহানোগ্লু অন্যতম।
- ম্যানচেস্টার ডার্বি: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যানচেস্টার সিটি
পুরো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জুড়েই রয়েছে বেশ
কিছু জনপ্রিয় ডার্বি। নর্থ-লন্ডন ডার্বি, মার্সিসাইড
ডার্বি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব ডার্বি ছাড়িয়ে উত্তেজনার পারদ
বেশি ওঠে ম্যানচেস্টার ডার্বিতে। বিশেষত গত এক দশকে এই ডার্বির জনপ্রিয়তা বেড়েছে
কয়েকগুণ। এর পেছনে অবশ্য মূল কারণ ম্যানচেস্টার সিটির উত্থান।
২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার সিটির মালিকানা
বদলের পর থেকেই পরাশক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠে সিটিজেনরা। পরবর্তী বছরেই ইউনাইটেড বাহিনীকে
৪-৩ গোলে হারায় সিটিজেনরা। ২০১১/১২ মৌসুমে ওল্ড ট্রাফোর্ডে গিয়ে ম্যানচেস্টার
ইউনাইটেডকে ৬-১ ব্যবধানে হারিয়ে ম্যানসিটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
যদিও শিরোপা কিংবা ইতিহাস সবদিক দিয়েই যোজন যোজন এগিয়ে আছে রেড ডেভিলরা। কিন্তু
সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবে সিটিজেনদের বিপক্ষে তেমন সুবিধা করতে পারেনি ম্যানচেস্টার
ইউনাইটেড। আর সেজন্যই দিনকে দিন এই ডার্বির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে।
- ইন্টারকন্টিনেন্টাল ডার্বি: ফেনারবাচে বনাম গ্যালতাসারে
তুরস্কের
রাজধানী ইস্তাম্বুলকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি ক্লাব- বেসিকতাস, ফেনারবাচে এবং গ্যালতাসারে। কিন্তু এদের মধ্যে
তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ফেনারবাচে এবং গ্যালতাসারের মাঝে। এই
ডার্বির আরেক নাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল ডার্বি। গ্যালতাসারে ক্লাবটি মানচিত্র
অনুযায়ী ইউরোপে পড়লেও ফেনারবাচে পড়েছে এশিয়ার অংশে।
এই ডার্বি উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে ১৯৯৬ সাল
থেকে। সেবার টার্কিশ কাপ ফাইনালে ফেনারবাচের মাঠে গিয়ে গ্যালতাসারে জয় তুলে নেওয়ার
পর তৎকালীন গ্যালতাসারে কোচ গ্রায়েম সৌনেস ম্যাচ শেষে গ্যালতাসারের পতাকা কিক অফের
জায়গাটায় পুঁতে দেন। তাতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ফেনারবাচে।
দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে ফেনারবাচের জয়
১০৩টিতে। অন্যদিকে গ্যালতাসারে জিতেছে ৮১ ম্যাচে। তবে ফেনারবাচের চেয়ে দুটি টার্কিশ
লিগ বেশি জিতেছে গ্যালতাসারে।
- দ্য ওল্ড ফার্ম ডার্বি: সেল্টিক বনাম রেঞ্জার্স
প্রিমিয়ার
লিগ থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ মুল্লুকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্বিটি স্কটিশ লিগে। গ্লাসগো
শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুই ক্লাব সেল্টিক ও রেঞ্জার্সের দ্য ওল্ড ফার্ম
ডার্বিটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্বি। এই দুই দলের সাথে জড়িয়ে রয়েছে
সাম্প্রদায়িকতাও।
গ্লাসগো শহরে ক্যাথলিক এবং প্রোটেসট্যান্ট
দুই ধরনের অনুসারীই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রোটেসট্যান্টরা অনেক ক্ষেত্রেই
ক্যাথলিকদের দ্বারা নিপীড়িত। আর এদিকে সেল্টিক ক্লাবটি ক্যাথলিকভিত্তিক হলেও
রেঞ্জার্স ক্লাবটি প্রোটেসট্যান্টদের দলে। তাই এই দুই দলের লড়াই শুধু খেলাতেই
সীমাবদ্ধ থাকে না।
শিরোপার সংখ্যায় সেল্টিককে ছাড়িয়ে উপরে রয়েছে
রেঞ্জার্স। রেঞ্জার্সের সর্বমোট ১১৫টি শিরোপার বিপরীতে সেল্টিকের ট্রফি কেবিনেটে
রয়েছে ১০৫টি শিরোপা।
- নর্থওয়েস্ট ডার্বিঃ লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
শ্রমিকদের হাত ধরেই ইংলিশদের ফুটবলের
অগ্রযাত্রা। শ্রমিকেরা তাদের অবসর সময়ে যে বল নিয়ে খেলে কাটাতো, তাই বড় হয়ে হয় প্রফেশনাল ফুটবল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশনের সবচেয়ে
প্রভাবশালী দুই শহর ছিল ম্যানচেস্টার আর লিভারপুল।
আইরিশ সাগরের পাড়ে হওয়ায় লিভারপুল ছিল
ইংল্যান্ডের অন্যতম বড় ডক। সবকিছু ভিড়তো সেই ঘাটেই। আর সেখান থেকে চলে যেত
অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরে। সে কারণে লিভারপুল শহরের বিজনেস ফুলে ফেপে উঠেছিল।
সে সময় ম্যানচেস্টার নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে তৈরি করে ‘দ্যা ম্যানচেস্টার
শিপ ক্যানেল’। যাতে করে শহরে মালামাল লিভারপুল থেকে ঘুরে নয়, বরং সরাসরি ম্যানচেস্টারে প্রবেশ করতে পারে। এতে করে ম্যানচেস্টারের
লাভ হলেও ক্ষতি হয় লিভারপুলের। ডকের কাজে নিয়োজিত অনেক শ্রমিকই চাকরি হারায়,
লোকসানে চলে যায় অনেক ডকিং কোম্পানি। অন্যদিকে ম্যানচেস্টারে
বাড়তে থাকে চাকরি, বাড়তে থাকে ডকিং ব্যবসা। আর তার কয়েক
মাস পরেই ছিল লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারের মধ্যকার খেলা। যে কারণে ব্যবসায়িক দ্বৈরথ
ফুটবল মাঠে গড়াতে বেশি সময় লাগেনি।
দ্বৈরথের শুরু আজ থেকে প্রায় ১২৬ বছর আগে, নিউটন হিথ আর লিভারপুলের মধ্যে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আগে নিউটন হিথ
নামেই পরিচিত ছিল। ইংলিশ লিগে প্রথমবারের দেখাতেই জয় ছিল অল রেডদের। তাও কোনো যে
সে জয় নয়। একেবারে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করা জয়। ব্যবসার
সাথে সাথে ফুটবলের মাঠেও যে কে রাজা তা দেখিয়ে দিয়েছিল লিভারপুল। যদিও পরের বারের
দেখায় লিভারপুলকে পালটা জবাব দিয়ে বসেছিল তারা। ৫-২ গোলের জয় অবশয় সেই ক্ষতে
প্রলেপ দিতে পারেনি।
মোট ২১১ বারের দেখায় ইউনাইটেড জিতেছে ৮২ বার
এবং লিভারপুল জিতেছে ৭১ বার।
- সুপার ক্লাসিকো: বোকা জুনিয়র্স বনাম রিভার প্লেট
আর্জেন্টিনার দুই ক্লাব রিভার প্লেট ও বোকা
জুনিয়র্স ‘প্রতদ্বন্দ্বিতা’ শব্দটিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। অন্যান্য ডার্বির
মতোই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে সমাজের শ্রেণী বিভাজনের ফলে। বোকা জুনিয়র্স
ছিলো সমাজের নিচু স্তর ও খেটে খাওয়া মানুষের দল। অন্যদিকে উঁচু শ্রেণীর প্রতিনিধি
ছিলো রিভার প্লেট। দুটি ক্লাবের উৎপত্তিই আর্জেন্টাইন রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সকে ঘিরে।
অফিসিয়ালভাবে ২৪৮ ম্যাচে বোকার জয় ৯১টিতে
এবং রিভার প্লেটের জয় ৮৫ ম্যাচে। লিগ শিরোপায় আবার এগিয়ে রিভার প্লেট। তারা ৬৩টি
শিরোপা জিতলেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা জিতেছে ৫৪টি শিরোপা। তবে মর্যাদাবান কোপা
লিবার্তোদোরোসে রিভার প্লেটকে টেক্কা দিয়েছে বোকা। বোকার ঝুলিতে রয়েছে ৬টি শিরোপা, যেখানে রিভার প্লেট জিতেছে ৪টি।
আক্ষরিক অর্থেই এই ডার্বি ঘিরে এত সহিংসতা
হয় যে, প্রতি ম্যাচেই নিয়োজিত করা হয় সহস্রাধিক পুলিশ
ও নিরাপত্তা কর্মী।
- এল ক্লাসিকো: বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ
ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব, গুণাগুণের দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে
ফুটবলের সবচেয়ে সেরা ডার্বিটি এল ক্লাসিকো। যা দেখার জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে
থাকেন সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকেরা।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় জেনারেল ফ্রাঙ্কো
১৯৩৬ সালে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন। সেই থেকে কাতালুনিয়ার
প্রতিনিধিত্ব করা বার্সেলোনার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় স্পেনের রাজধানী
মাদ্রিদভিত্তিক ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের।
ম্যাচ চলাকালীন সময়ে এল ক্লাসিকোতে
খেলোয়াড়দের হাতাহাতি কিংবা দর্শকদের মারামারি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বার্সেলোনা
ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার দরুণ লুইস ফিগোর দিকে শুকরের মাথা ছুঁড়ে মারার
ঘটনাও ঘটেছে এক ম্যাচে। সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়েরা বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল
মাদ্রিদে খেলার সুবাদে ম্যাচ হয়ে ওঠে আরো চিত্তাকর্ষক।
এল ক্লাসিকো মূলত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে যায়
লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দ্বৈরথের কল্যাণে। তারা চলে যাওয়ায় এখন সেই
জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে।
দুই দলের ২৫২ বারের দেখায় রিয়াল মাদ্রিদ
জিতেছে ১০১ টি ম্যাচ এবং বার্সেলোনা জিতেছে ১০০ টি ম্যাচ। স্ট্যাটসই প্রমাণ করে দেয় কেন এল
ক্লাসিকো ফুটবলের সেরা ডার্বি।
টোটাল ট্রফির দিক দিয়ে বার্সেলোনার ৯৭ টির
বিপরীতে রিয়াল জিতেছে ৯১ টি। তবে প্রেস্টিজিয়াস ট্রফি লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স
লিগের দিক দিয়ে আবার রিয়াল মাদ্রিদ অনেক এগিয়ে। তারা জিতেছে ৩৪ টি লা লিগা এবং ১৪
টি ইউসিএল। অন্যদিকে বার্সা জিতেছে ২৬ টি লা লিগা এবং ৫ টি ইউসিএল।