ইয়াজিদি ধর্মের নাম শুনেছেন? অথবা জরথুস্ত্র কিংবা জৈন ধর্ম? ধর্ম বলতে আমরা সাধারণ মানুষরা মূলত ৫ থেকে ৬ টি মেজর ধর্মই বুঝি। কিন্তু পৃথিবীতে ধর্ম আছে মোট ৪ হাজারের কাছাকাছি! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য। এর মধ্যে প্রচুর উইয়ার্ড ধর্মও আছে। মিডসামার কিংবা দ্য উইকার ম্যান সিনেমা দেখলে হয়তো বুঝবেন ধর্ম কি পরিমাণ উইয়ার্ড হতে পারে। আজকে সেরকমই কয়েকটি অদ্ভুতুড়ে ধর্ম নিয়ে কথা বলবো। আর দেরি না করে চলুন শুরু করা যাক।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
নাম্বার সেভেন - বাহাই ধর্ম
বাহাই ধর্ম হচ্ছে বাহাউল্লাহর বানানো এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী একটি ধর্ম। এই ধর্মের শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যে অর্থাৎ বর্তমানের ইরানে। মূলত মানবজাতির আত্মাকে একসাথে করাই এই ধর্মের মূল ভিত্তি। বর্তমানে পৃথিবীতে ২০০-এরও বেশি দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ বাহাই ধর্মের লোকজন আছে। বাংলাদেশেও বাহাই ধর্মের অনুসারী মানুষজন আছেন। শান্তিনগরে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় বাহাই কেন্দ্র। আরেকটি ব্যাপারে জানলে হয়তো অবাক হবেন। বাংলাদেশের একটি থ্রিলার উপন্যাসেও উঠে এসেছে বাহাই ধর্ম। ২০১৩ সালে মাশুদুল হক ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ নামক একটি কন্সপিরেসি থ্রিলার উপন্যাস লেখেন। সেই বইয়ের মাধ্যমে প্রচুর মানুষ বাহাই ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়।
বাহাইরা মনে করে ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন সময়ে স্বর্গ থেকে মহামানবরা পৃথিবীতে এসেছেন। এদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম (আঃ), গৌতম বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মদ (সঃ) ও অন্যান্যরা। তারা বিশ্বাস করে মুহাম্মদ (সঃ) ই শেষ মহাপুরুষ না, এরপরে এসেছেন বাব ও বাহাউল্লাহ। বাহাই ধর্ম মতে এরা প্রত্যেকেই তাদের আগে আসা মহামানবদের অনুসরণ করতে বলে গেছেন। তবে বাহাউল্লার জীবন ও তার দেওয়া শিক্ষার মাধ্যমেই তাদের ধর্ম পূর্ণতা পেয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে।
নাম্বার সিক্স - জৈন ধর্ম
জৈন মূলত একটি সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় বিজয়ী। এই ধর্মের মূল বিশ্বাস হলো, পৃথিবীতে ২৪ জন ‘তীর্থঙ্কর’ বা বিজয়ী মহাপুরুষের আগমন ঘটেছিল, যাঁরা নিজ নিজ সময়ে মানবজাতির ত্রাণকর্তা ও শিক্ষক ছিলেন। এই ২৪ জনের মধ্যে সবার আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন ঋষভ, সে লাখ লাখ বছর আগের কথা। সর্বশেষ ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের আগমন ঘটে ফিফথ সেঞ্চুরির দিকে।
জৈন মূলত একটি ভারতীয় ধর্ম। অহিংসা ও আত্মসংযমের মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যু-জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ করাই জৈন ধর্মের মূল সাধনা। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ জৈন ধর্মের অনুসারী, যাদের তিন ভাগের এক ভাগ থাকে ভারতে।
নাম্বার ফাইভ - জরথুস্ত্রবাদ
জরথ্রুস্ট ছিলেন একজন প্রাচীন পার্সি ধর্ম প্রচারক। তার নামেই রাখা হয়েছে জরথ্রুস্ট ধর্মের নাম। ভারতীয় উপমহাদেশে একে পার্সি ধর্ম বলা হয়। এককালে এটি ছিল প্রাচীন ইরানের আকামেনিদ, পার্থিয়ান এবং সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের জাতীয় ধর্ম। বর্তমানে ইরানের জরথ্রুস্ট সম্প্রদায় ও ভারতের পার্সী সম্প্রদায় এই ধর্মের চর্চা করে।
জরথ্রুস্ট একজন হিস্টোরিকাল পার্সোনালিটি, কিন্তু তার টাইমলাইন সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছুই জানা যায়না। অনেক পন্ডিত মনে করেন যীশু খ্রিষ্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে তার আগমণ ঘটেছিল পৃথিবীতে।
এ ধর্মে ঈশ্বরকে আহুরা মাজদা নামে ডাকা হয়। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম আবেস্তা। এই ধর্মের অনুসারীরা মূলত অগ্নি-উপাসক অর্থাৎ তারা আগুনের পূজা করে। আগুনের পবিত্রতাকে তারা ঈশ্বরের পবিত্রতার সাথে তুলনা করে। ইহুদী ও খৃস্টান ধর্মেও জরথ্রুস্টকে ঈশ্বরের পাঠানো মহামানব হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার জরথ্রুস্ট ধর্মের মানুষ আছে। এই ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠানের নাম নওজোত। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অফিশিয়ালি জরাথ্রুস্ট ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়। ৭ বছরের আগে কেউ নওজোতে বসতে পারে না। তবে ৭ বছরের পরে যে কোনো বয়সেই নওজোতের মাধ্যমে জরাথ্রুস্ট বা পার্সি ধর্মে দীক্ষা নেওয়া যায়।
নাম্বার ফোর - তাও ধর্ম
দ্বিতীয় শতাব্দিতে চীনে তাও ধর্মের জন্ম হয়। এই ধর্মের ইতিহাস প্রায় ১ হাজার ৮ শো বছরেরও পুরনো। তাওধর্মের লোকেরা প্রাচীন চীনের প্রকৃতি ও তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে পূজা করে। এক সময় এই ধর্মের বহু সম্প্রদায় ছিলো। সময়ের সাথে সাথে এখন শুধু দুটি বড় সম্প্রদায় আছে তাওদের মধ্যে। সেগুলো হচ্ছে ছুয়েন চেন তাও ও চেন ই তাও। হান জাতির মধ্যে তাওধর্মের বেশ প্রভাব রয়েছে। তাও ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম কানুন নেই। ফলে এদের সঠিক সংখ্যা গণনা করা বেশ কঠিন। চীনে তাওধর্ম মন্দিরের আছে দেড় হাজারটি। এইসব মন্দিরে মেয়ে ও পুরুষ মিলিয়ে ধর্ম প্রচারকের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।
নাম্বার থ্রি - শিন্টো ধর্ম
জাপানের স্থানীয় এবং আনঅফিশিয়াল ন্যাশনাল রিলিজিয়ন হচ্ছে শিন্টো। এটা এমন একটা ধর্ম, যেখানে কোনো ঈশ্বর নেই, প্রচারক নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই, পরকাল নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন। শিন্তো ধর্মের মূলকথা হলো, সৃষ্টিকর্তা বলতে কেউ নেই। তবে কিছু স্বাধীন আত্মা বা স্বর্গীয় সত্তা আছেন, যাঁদের নাম ‘কামি’। এই কামিরা পৃথিবীর মানুষের ভালো চায়। যেকোনো ধর্মের মানুষ শিন্টো মন্দিরে যেতে পারে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শিন্টো মতবাদে বিশ্বাস করে।
নাম্বার টু - ইয়াজিদি ধর্ম
আমরা সাধারণ মানুষজন যেসব মেজর ৪-৫ টি ধর্ম সম্পর্কে জানি, সেগুলোতে দেখা যায় কোন এক বা একাধিক এনটিটিকে ভক্তি করা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমনও এক ধর্ম আছে যেখানে পূজা করা হয় ইবলিশের! সেই ধর্মের নাম ইয়াজিদি ধর্ম।
এই ধর্মটি তৈরি করেছিলেন শেখ আদি ইবনে মুসাফির। তিনি ছিলেন উমাইয়া খলিফা মারওয়ান বিন আল-হাকামের একজন উত্তরসূরী। ১০৭০ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননের বেকা ভ্যালির বাইত ফার গ্রামে জন্ম হয় তার। সেই ঘরটিকে এখন পবিত্র ঘর মানে ইয়াজিদিরা।
ইয়াজিদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ দুটি। কিতাব-আল-জিলওয়াহ ওরফে বুক অফ রেভেলেশন ও মাশাফ রাশ ওরফে ব্ল্যাক বুক। এই দুটো গ্রন্থই মালেক তাউসের বাণী। অর্থাৎ আমরা যাকে ইবলিশ মানি। মালেক তাউস অর্থ ময়ূর প্রভু। ইয়াজিদিরা ইবলিশকে ময়ূররুপেই পূজা করে। এছাড়াও তারা প্রধান সাত ফেরেশতার পূজা করে। প্রত্যেক ফেরেশতার জন্য আলাদা আলাদা মূর্তি বানিয়ে নিয়েছে তারা। সেগুলোকে বলা হয় সানজাক।
ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে দোজখ আগে ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। আল্লাহর আদেশ অমান্য করার পরে যখন ইবলিশকে শাস্তি দেওয়া হয়, তখন তিনি অনুশোচনায় ৭ হাজার বছর কান্না করেন। সেই চোখের পানিতেই নাকি ৭ টি পাত্র পূর্ণ হয় ও দোযখের আগুন নিভে যায়!
বর্তমানে পৃথিবীতে ইয়াজিদিদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। তারা নিজেদেরকে দাসনি (Dasni) নামে পরিচয় দেয়। তাদের সম্প্রদায়ে সবসময় একজন প্রধান থাকে। যাকে বলা হয় খলিফা। তার আন্ডারে থাকে শেখ, কাভভাল ও ফাকির নামক বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার পদ।
নাম্বার ওয়ান - ভুডু ধর্ম
পশ্চিমা বিশ্ব ভুডুকে প্রায়ই ডাইনী বা ডাকিনীবিদ্যা অর্থাৎ শয়তান পূজারীদের সাথে গুলিয়ে ফেলে। আসলে ভুডু অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একটি ধর্ম। কারণ তারা খারাপ আত্মা নয়, বরং ভালো আত্মার প্রার্থনা করে, যা তাদের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে।
এই ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি একইসাথে সর্বেশ্বর এবং একেশ্বরবাদী। তাই ভুডুয়ানরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একজন পরম ঈশ্বরে আস্থা রাখে। ভুডুয়ানরা যাকে গুড গড বা ভালো ঈশ্বর বলে ডাকে, তার নাম বনডাই।
তবে খানিকটা হিন্দু ধর্মের মতো বিভিন্ন জগতকে কেন্দ্র করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবী রয়েছে। ভুডুয়ানদের মোট দেবতার সংখ্যা ১০০, যাদেরকে তাদের ভাষায় মাহু বলা হয়। দেবতাদের নামগুলোও বেশ অদ্ভুত। যেমন- যুদ্ধবাজদের দেবতার নাম গৌ, রোগব্যাধি, আরোগ্য এবং মাটির দেবতার নাম সাকপাতা, ঝড়, বজ্রপাত আর ন্যায়বিচারের দেবতার নাম হেভিয়রসো আর পানির দেবতার নাম মামি ওয়াটা।
ধর্ম হিসেবে ভুডুর চর্চা কেবল বেনিন বা পশ্চিম আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, বরং এটি এর পার্শবর্তী দেশ টোগো, নাইজেরিয়ারও অন্যতম প্রধান ধর্ম। এছাড়াও মধ্য আমেরিকার দেশ হাইতি, কিউবা কিংবা নিউ অরলিয়েন্স এবং লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলেও ব্যাপকভাবে ভুডুর চর্চা রয়েছে। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ধর্ম ভুডু।