“জনগণ আমার নিজ সন্তানের মতো। আমি তাদের পিতার মতোই স্নেহ করি। একজন পিতা যেমন সর্বদা তার সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে, আমিও আমার রাজ্যবাসীদের মঙ্গল কামনা করি, সর্বদা তাদের সুখ-শান্তির জন্যে প্রার্থনা করি।”
এই উক্তিগুলো ছিলো একজন সম্রাটের, আজ থেকে তেইশ শত বছর পূর্বে যিনি রাজত্ব করেছিলেন পৃথিবীর একাংশে। যেই সম্রাটের ছিল নিজস্ব সিক্রেট সোসাইটিও। যা ছিল উপমহাদেশের প্রথম সিক্রেট সোসাইটি।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন সম্রাট অশোক মৌর্য্য। বিন্দুসার ও ধর্মার সন্তান আর মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের নাতি ছিলেন অশোক দ্যা গ্রেট। ভারতের ইতিহাসে দুজন রাজাকে গ্রেট উপাধি দেয়া হয় তাদের একজন হলেন এই সম্রাট অশোক আরেকজন মুঘল সম্রাট আকবর। অশোক প্রথম জীবনে বৈদিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তার শাসনকাল ছিল ২৯৮ থেকে ২৭২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। রাজা হবার পর থেকেই অশোক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। তিনি পূর্বে বর্তমান আসাম ও বাংলাদেশ, পশ্চিমে ইরান ও আফগানিস্তান, উত্তরে পামীর গ্রন্থি থেকে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
এরপর অশোক কলিঙ্গ প্রজাতন্ত্র দখলে উদ্যোগী হন যা তার পূর্বপুরুষেরা কখনোই জয় করতে পারেনি। লক্ষাধিক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অশোক কলিঙ্গজয় করেন। কিন্তু যুদ্ধজয়ের এই বীভৎসতা সম্রাট অশোককে মানসিকভাবে পরাজিত করে দেয়।
অনুশোচিত সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। রণাঙ্গনপ্রিয় যুদ্ধবাজ রাজা নিজেকে রুপান্তরিত করেন শান্তিপ্রিয় অহিংসার মানুষে। প্রতিষ্ঠা করেন এক রহস্যময় সমাজের যাদের কাজ ছিল জ্ঞানের এমন কিছু ধারাকে সংরক্ষণ করা যা মন্দ লোকের হাতে পড়লে মানবসভ্যতার সর্বনাশ হবার প্রবল সম্ভাবনা ছিল।
ইতিহাস ঘাঁটলে এই নয়জন মানুষ সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। এমনকি তাঁরা আসলে কারা কারা ছিলেন, তাঁদের নামই বা ঠিক কি ছিল তা আজও রহস্যের চাঁদরে মোড়া। তবে অনেকের মতে এই নয়জন মানুষ নাকি অমরত্ব লাভ করতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন তাঁদের উপর অর্পিত নিজ নিজ বিভাগে জ্ঞান অন্বেষণের আতিশয্যে পৌঁছাতে। সম্রাট অশোক এই নয়জন মানুষকে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশমতে এই নয় জ্ঞানী পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁদের স্বীয় স্বীয় ক্ষেত্রের উপর যাবতীয় জ্ঞান সংগ্রহপূর্বক এক জায়গায় সন্নিবেশিত করেন। শুধু তাই নয়, এসব জ্ঞান যাতে ভুল লোকের হাতে না পড়ে তার জন্যও নিখুঁত নিরাপত্তা ও নিখাদ গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হয়।
সেই নয়টি বিষয় হচ্ছে প্রোপাগান্ডা ও সাইকোলজিকাল ওয়ার স্ট্র্যাটেজি, বায়োলজি, অ্যালকেমি, কমিউনিকেশন, মাইক্রোবায়োলজি, গ্র্যাভিটি ও অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি, কসমোলজি, অপটিকাল সায়েন্স ও সোশ্যাল সায়েন্স।
ধারণা করা হয় তারা বেশ কিছু অ্যাডভান্সড ও কমপ্লেক্স বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। সেগুলো হলো টাচ অফ ডেথ, অ্যালকেমি ও পরশপাথর, টেলিপ্যাথি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী। এছাড়াও টাইম ট্রাভেল, ভিমানা নামক এক প্রাচীন ইউএফও আবিষ্কার এবং অণুজীব ব্যবহার করে সম্পূর্ণ গঙ্গা বিশুদ্ধকরণ ও মহৌষধে রুপান্তরের মতো আদতে অবাস্তব কাজও নাকি তারা সম্ভব করেছিলেন সেই সময়ে।
উল্লেখ্য, টাচ অফ ডেথ হচ্ছে মার্শাল আর্টের এক গুপ্ত ঘায়েলবিদ্যা। চাইনিজরা এটাকে “ডিম মাক” বলে থাকে। বর্তমান পৃথিবীর খুবই অল্পসংখ্যক মার্শাল আর্টিস্ট এই বিদ্যা জানেন। অনেকেই সন্দেহ করে থাকেন যে বিখ্যাত মার্শাল আর্টিস্ট ব্রুস লির মৃত্যু এই “টাচ অব ডেথ” এর মাধ্যমে হয়েছিল। “টাচ অব ডেথ” এর দ্বারা নিউরন পর্যায়ে আঘাত করার মাধ্যমে ভিক্টিমকে ইন্সট্যান্ট ডেথ না দিয়ে বরং বিলম্ব মৃত্যু ঘটিয়ে হত্যার সঠিক কারণ লুকানো যায়।
যারা যারা এই সিক্রেট সোসাইটি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন তাদের মধ্যে লুইস জ্যাকলিয়ট, ট্যালবট মুন্ডি, লুইস পাওয়েল ও জ্যাকস বার্গারকে পথিকৃৎ বলা যায়। লুইস পাওয়েল ও জ্যাকস বার্গার তাদের “দ্য মর্নিং অফ দ্য ম্যাজিশিয়ান্স” বইতে এই নয়জনের তাঁদের সংঘের বাইরের বিভিন্নজনের সাথে বিভিন্ন সময় যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন।
পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার ছিলেন সেই বাইরের মানুষদের একজন। বলা হয় যে, পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার ছিলেন এক রহস্যময় মানুষ। তার কাছে লেজেন্ডারি ‘ব্র্যাজেন হেড’ ছিল। মানুষের মাথার মতো দেখতে এই যন্ত্রটি নাকি যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো। সিলভেস্টারের এই কিংবদন্তি কিন্তু তার জীবনের একেবারে শুরুতেই ছিল না। তিনি একবার ভারত সফরে আসেন। তারপর থেকেই এই রহস্যময়তা। অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের অবতারণা করলে বলা যায়, এই একই রকম যন্ত্র দার্শনিক রজার বেকনের কাছেও ছিল যাকে বলা হয় “ডক্টর মিরাবিলিস” অর্থাৎ বিস্ময়কর শিক্ষক। যাই হোক, অনেকেই ধারণা এই কিংবদন্তিতুল্য যন্ত্রের সন্ধান সিলভেস্টার সেই সিক্রেট সোসাইটির কাছ থেকে পেয়েছিলেন যা সম্রাট অশোক বহুকাল আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরও একটা বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায় যেখানে এই ব্যাপারে একটু বিশদভাবে বলা হয়েছে। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ট্যালবট মুন্ডির বই “দ্য নাইন আননৌন”।
“দ্য নাইন আননৌন মেন” ইতিহাসের এক রহস্যময় নাম। ধারণা করা হয়, এই সিক্রেট সোসাইটি নির্দিষ্ট নয়জন মানুষের কোন দল নয়। বরং যুগে যুগে কালে কালে পৃথিবীর অনেক জ্ঞানীগুণী এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তবে সংখ্যাটা সবসময়ে নয়ই থাকতো। তবে একটা কথা কিন্তু নিরেট সত্য- “এই বর্তমান পৃথিবী এক বঞ্চিত পৃথিবী। সে এমন কিছু জ্ঞান, এমন কিছু বিদ্যা, এমন কিছু প্রযুক্তি সময়ের স্রোতধারায় হারিয়েছে যা পুনর্বার খুঁজে পাওয়া দুষ্করই বটে।