স্লিপ প্যারালাইসিস কিংবা বোবায় ধরা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ব্যাপারটা আসলে কি? এটা কি অতিপ্রাকৃত কোন ব্যাপার নাকি নিতান্তই সায়েন্টিফিক কোন ব্যাপার?
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
হঠাৎ মধ্যরাতে আপনার ঘুম ভেঙে গেল। আপনার বুকের ওপর ভারী কিছু বসে আছে বলে অনুভব করলেন। এত ভারী কিছু যে ঠিকঠাক নিশ্বাসই নিতে পারছেন না। যখন টের পেলেন, আপনি চাইলেও শরীরের কোনো অংশ নাড়াতে পারছেন না, এমনকি চিৎকারও করতে পারছেন না। এটি সাধারণত একজন ব্যক্তির ঘুমিয়ে পড়া বা জেগে ওঠার আগমুহূর্তে ঘটে। সহজ কথায় নিজেকে এমন অসহায়ভাবে আবিষ্কার করাকেই স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা বলে।
‘বোবায় ধরা’, এই পরিভাষাটির সাথে একদমই পরিচয় নেই, এমন মানুষ বোধ হয় পাওয়াই যাবে না। মাঝরাতের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা বা মনঃস্তত্ত্বের জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া কিংবা লোকমুখে শোনা নানা উপকথা-কুসংস্কার থেকে বোবায় ধরা সম্পর্কে জেনেছেন। বোবায় ধরার পেছনের কারণ কী বা প্রকৃত অর্থেই কী ঘটে থাকে, এ ব্যাপারে দু’রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়- একটি প্যারানরমাল ব্যাখ্যা, অন্যটি সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা।
তবে যা-ই হোক, ব্যক্তিভেদে অভিজ্ঞতার ধরন মোটামুটি একই রকম- তবে যা-ই হোক, ব্যক্তিভেদে অভিজ্ঞতার ধরন মোটামুটি একই রকম- ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং কিছুক্ষণের জন্য বাকশক্তি, চলনশক্তি হারিয়ে ফেলা। এর বাইরে ঘুম ভাঙার আগে-পরে অনেকে অনেক কিছু অনুভব করেন, কেউ ঘরের ভেতর ভৌতিক কিছুর উপস্থিতি টের পান, কেউ দুর্গন্ধ পান, কেউ বা আবার ভয়ানক কোনো প্রাণী দেখতে পান। এই পুরো ঘটনাটিই হচ্ছে বোবায় ধরা।
বাংলায় ‘বোবায় ধরা’ নামকরণটি মূলত এসেছে গ্রাম্য লোককাহিনী থেকে। বলা হয়, বোবা নামের ভূত ঘুমের ভেতর মুখ চেপে ধরে, তাই চোখ খুলেও মানুষ তখন কথা বলতে পারে না। একেই ‘বোবায় ধরা’ বলে। তবে সেই ভূতটির নাম কেন ‘বোবা’, সেটিও বোঝা কঠিন নয়। বোবা বানিয়ে দেয়, তাই ‘বোবা’। বোবায় ধরলে ব্যক্তি যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে অতি-অল্প সময়ের জন্য বাক ও চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন, সেহেতু এটিকে স্লিপ প্যারালাইসিস বলা হয়।
এবারে স্লিপ প্যারালাইসিসের প্যারানরমাল দিকটার আরেকটু গভীরে ঢোকা যাক। আমরা জানি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হতে হলে অবশ্যই জ্বীন জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে জাছুম টার্মটি হচ্ছে কাবুস অর্থাৎ বোবায় ধরা, যা ঘুমের মধ্যে মানুষের ওপর ভর করে। জাছুম কখনও শরীরের কোন অঙ্গগত বৈষয়িক কারণেও হতে পারে; যেমন কোন খাবার বা ঔষধের প্রভাবে। আবার কখনও জ্বিনের প্রভাবেও হতে পারে।
ইবনে সিনা তাঁর চিকিৎসা গ্রন্থ “আল-ক্বানুন” এ বলেন:
“কাবুস পরিচ্ছেদ: এটি এমন এক রোগ যার কারণে মানুষ ঘুমে প্রবেশকালে অনুভব করে যে, ভারী কাল্পনিক কিছু তার উপরে পড়ছে। তাকে চাপ দিচ্ছে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলছে। যার ফলে তার শব্দ আটকে যাচ্ছে, সে নড়াচড়া করতে পারছে না। যেন সে শ্বাস আটকে মারা যাবে। যখন এই অবস্থা কেটে যায় তখন আচমকা জেগে ওঠে। এটি তিনটি রোগের সূচনা: খিঁচুনি, স্ট্রোক করা কিংবা ম্যানিয়া; যদি এটি বিভিন্ন পদার্থের জট পাকানোগত কারণে হয় এবং কোন অবৈষয়িক কারণে না হয়।”
এবারে দেখা যাক বিজ্ঞান কি বলে। স্লিপ স্পেশালিস্টদের মতে, বোবায় ধরা তেমন গুরুতর কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। তাই ঐ অর্থে কোনো রোগ বা রোগের আলামত বলতেও তারা চান না। তাদের মতে, বোবায় ধরা হচ্ছে একটি ইন্টার্নাল স্টেট, যেখানে আমরা ঘুম ও জাগরণের একটি মাঝামাঝি স্টেটে অবস্থান করি। ঘুমোনোর সময় আমাদের মস্তিষ্ক কথা বলা সহ চলনক্ষমতা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে, যাতে আমরা ঘুমের মাঝে চলতে গিয়ে আঘাত না পাই। কিন্তু এর মাঝেই অনেক সময় আমরা জেগে উঠি। অর্থাৎ কখনো কখনো মস্তিষ্কের সক্রিয় অংশের পুরোটা একত্রে কার্যকর হয় না। তখন অন্য অনুভবশক্তি সচল থাকলেও চলন ও বাকশক্তি ফিরতে একটু সময় নেয়। এর মাঝেই তৈরি হয় টেম্পোরারি প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা।
পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ব্রায়ান শার্পের মতে, বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে তিন ধরনের দৃষ্টিভ্রম বা হ্যাল্যুসিনেশন তৈরি হতে পারে।
- প্রথমটি "ইনট্রুডো" বা ঘরের ভেতর কোনো অতিপ্রাকৃত কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া।
- দ্বিতীয়টি "ইনকিউবিস"। আপনার মনে হতে পারে যে, কোনো দৃশ্যমান বা ঈষৎ-অদৃশ্য সত্তা আপনার বুকের ওপর চেপে বসে আছে।
- কম ঘুমানো
- ঘুমের সময় পরিবর্তন
- উপুড় হয়ে ঘুমানো
- মাদকাসক্তি
- বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা এ জাতীয় মানসিক সমস্যা থাকা
- নার্কোলেপ্সি বা অতি ঘুমকাতরতা, ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোঁড়া বা হাঁটা সহ অন্যান্য নিদ্রাজনিত রোগ থাকা
- সক্রিয়তা বর্ধক ঔষধ ব্যবহার
- নিয়মিত কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমাবেন।
- ঘুমানোর পদ্ধতি পাল্টান। বিশেষত উপুড় হয়ে কখনোই ঘুমাবেন না।
- চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট বড়ি সেবন করতে পারেন ঘুমের জন্য।
- অন্যান্য নিদ্রাজনিত বা মানসিক সমস্যা থেকে থাকলে সেগুলোর চিকিৎসা নিন।