‘হযবরল’ নামে সুকুমার রায়ের একটি কমেডি গল্প ছিল। সেখানে একটি উদ্ভট প্রাণির কথা বলা হয়েছে। যার নাম হিজিবিজবিজ। আচমকাই অদ্ভুত সব কথা মনে পড়লে যার পেট ফেটে যেত হাসতে হাসতে। তার উদ্ভট খেয়ালে একবার মনে হয়েছিল পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হত, আর সব পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে যেত, তাহলে কি কেলেঙ্কারি ব্যাপার-ই না হত। সে কি আর জানতো পৃথিবীতে আসলেই এমন চিন্তাধারার মানুষ আসলেই আছে! যাঁরা ‘যদি’ নয়, সত্যিই বিশ্বাস করেন পৃথিবীটা চ্যাপ্টা! শুনতে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক, ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটির সদস্য ক্রমেই বাড়ছে! এমন না যে এরা সব পাগল-ছাগল খামখেয়ালি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই নিজের সেক্টরে সাকসেসফুল মানুষজন।
বহুযুগ আগে পৃথিবীর আকার-আকৃতি
নিয়ে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস ছিল। কিন্তু গ্রিক দার্শনিক
এরাটোস্থেনিস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো প্রমাণ করেন পৃথিবী
গোলাকার। তারপর ধীরে ধীরে সেই ধারণা আরো শক্ত হতে থাকে। যার লাস্ট এভিডেন্স
মানুষের মহাকাশ যাত্রা। সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, আমাদের এই নীল
রঙের গ্রহটা গোলাকার।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
কিন্তু এরই মধ্যে কীভাবে যেন একদল
লোকের মধ্যে এই ধারণা গজিয়ে উঠল, নাহ, পৃথিবীটা চ্যাপ্টা। ব্রিটিশ সাহিত্যিক
স্যামুয়েল রোবথাম উনিশ শতকের বেশ নামজাদা এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি দাবি করেন,
পৃথিবী চ্যাপ্টা এবং এর একদম মাঝখানে আছে উত্তরমেরু। কি আশ্চর্য
কথাবার্তা! অনেকেই তাঁর আজগুবি তথ্যে কান দিতে শুরু করলেও ব্যাপারটা আরও দানা
বাঁধে একেবারে বিংশ শতাব্দীতে এসে।
১৯৫৬ সালে ব্রিটেনে শুরু হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্ল্যাট আর্থ রিসার্চ সোসাইটি’। কিন্তু ঘটনা হল, এগুলো সবই ছিল ছড়ানো-ছিটানো ঘটনা। বর্তমান সময়ে এসে ইন্টারনেটের রমরমা যুগে আমেরিকায় এটি নিয়ে আবারও গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। আর তা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। ২০০৯ সালে নামটা একটু ছোট করে নতুনভাবে ফিরে আসে ‘ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি’। শুরু হয় অ্যানুয়াল কনফারেন্স পর্যন্ত! সেই কনফারেন্সে দলে দলে এসে লোকে আলোচনা করতে থাকে, কীভাবে একটা সত্যিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে নাসা! বিশ্ববাসীর কাছে মিথ্যা প্রচার করে যাচ্ছে, পৃথিবী নাকি গোল! অনেকেই মনে করে, এইসবই পশ্চিমা বিশ্বের খামোখা খেয়াল? জমিদাররা যেমন সময় কাটাতে বিড়ালের বিয়ে দিতেন! এটিও তেমনই এক টাইম পাস নয়তো?
তবে টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাইকোলজিস্ট অ্যাশলে ল্যানড্র্যামের কথা শুনলে তা মনে হয় না। তিনি ২০১৮ সালে
কলোরাডোর ডেনভারে ‘ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি’-র সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি মূলত
পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা আইডিয়া নেওয়ার জন্য কৌতুহলবশতই সেখানে গিয়েছিলেন। সেখান
থেকে ফিরে তিনি বলেন
‘‘ওরা যদি শুধুই অন্যদের ভড়কে দিতে এসব করে থাকে, তাহলে মানতেই হবে যে ওরা রীতিমতো প্রোফেশনাল অ্যাক্টর। মিনিমাম ৯০ জন
মেম্বারের সাথে আমি কথা বলেছি। তারা রীতিমতো নিষ্ঠার সাথে বিশ্বাস করে যে পৃথিবী
সমতল!’’
এই বিশ্বাসের ব্যাপারটা বুঝতে
গেলে ‘পাগলা মাইক’ এর কথা বলতেই হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্বঘোষিত বিজ্ঞানী মাইক
হিউজকে এই নামেই ডাকত তার প্রতিবেশীরা। তার দাবি ছিল, নিজের তৈরি
রকেটে চেপে ১৫০০ মিটার উপরে উঠতে পারলেই তিনি প্রমাণ করে দেবেন নাসা ও বিজ্ঞানীদের
এতদিনের সব ভাওতাবাজি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনাড়ি হাতে বানানো সেই রকেট ভেঙে পড়ে গত
ফেব্রুয়ারিতে মারা গিয়েছেন তিনি। পৃথিবী চ্যাপ্টা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের প্রাণটাই
হারিয়ে বসতে হল বেচারাকে।
সোসাইটির সম্মেলনে গেলে এমন অনেক
পাগলা মাইকের সাথেই আলাপ হবে আপনার। প্রতিবারই বাড়ছে সম্মেলনে ভিড়। প্রথম দিকে
হাতেগোণা দুইশ লোক হত। এখন তা বাড়তে বাড়তে ছয়শোতে পৌঁছেছে। তবে এরা সকলেই যে এক রকম
ভাবে ব্যাপারটায় বিশ্বাস করে তাও না। নানা মুনির নানা মত আরকি। কারও মতে, চ্যাপ্টা এই
পৃথিবীর প্রান্ত ঘিরে রেখেছে বরফের দেয়াল। তারাই সমুদ্রগুলিকে ধরে রেখেছে। আবার
কেউ বিশ্বাস করেন, একটা অতিকায় বরফের গোলকের মধ্যে বসানো
রয়েছে এই চ্যাপ্টা গ্রহটা। এদের বেশির ভাগই পাত্তা দেন না মাধ্যাকর্ষণকেও। তাঁদের
মতে পৃথিবী নাকি ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড বেগে পাক খাচ্ছে। সেখান থেকেই মাধ্যাকর্ষণের এই
‘ভ্রান্তি’ তৈরি হচ্ছে! ইউটিউব ঘেঁটে দেখলে তাদের এই ধরণের উদ্ভট ও আজগুবি সব
থিওরির ভিডিও দেখতে পাবেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে...কেন? কেন বিজ্ঞানের
প্রতিষ্ঠিত এক চরম সত্যকে এভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাওয়া? এরা কি ন্যূনতম শিক্ষাটুকুও পায় নি? নাহ।
ব্যাপারটা তা নয়। সাইকোলজিস্ট অ্যাশলে ল্যানড্র্যামের মতে, এর সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতা কিংবা বিজ্ঞান শিক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। তার
মতে, অথোরিটির বিরোধিতা করার মানসিকতাই এই সব বিশ্বাসীদের
একদম শিকড়ে গেঁথে গেছে। ব্যাপারটাকে বিভিন্ন ধর্মীয় গোঁড়ামির সাথেও তুলনা দেওয়া
যায়। ল্যানড্র্যামের মতে, যে করেই হোক, এই সব মানুষগুলির ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করা দরকার। আর তা করতে হবে বিজ্ঞানী
ও গবেষকদেরই। তিনি বলছেন, ‘‘বসে বসে ওদের দেখে হাসলে চলবে
না। আমরা হেসে চলব আর ওরা দলভারী করতে থাকবে। ধীরে ধীরে বাড়বে উদ্ভট এই ফ্ল্যাট
আর্থ বিলিভারদের সংখ্যা।’’
‘কন্সপিরেসি থিওরি’ নিয়ে গবেষণা
করছেন কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্যারেন ডগলাস। তার মতে, ‘‘এদের
উদ্দেশ্য কোনও মতকে প্রতিষ্ঠা করা কিংবা অন্য কোনও কারণ না। এরা সকলেই মন থেকে
বিশ্বাস করে পৃথিবী গোলাকার না, চ্যাপ্টা।’’
ইন্ডিয়ার ওয়েস্ট বেঙ্গলে কেসি পাল
নামে একজন ছিলেন। ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’ এই বিশ্বাসের চারদিকে পাক খেয়েই
পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন তিনি। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে হইচইয়ের ডকুমেন্টারিও।
‘ফ্ল্যাট আর্থার’-রা সবাই তাঁরই জাতভাই। শুধু বিশ্বাসের স্টাইলটা আলাদা। কিন্তু
বিশ্বাসের শিকড় একই রকম গভীর।