২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। চীনের উহান শহরে নতুন একটি ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। এর নাম দেওয়া হয় কোভিড-নাইন্টিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ। যার মধ্যে মারা যাওয়া রোগির সংখ্যা প্রায় ৫৬ লাখ! ২০১৯ থেকে ২০২১ – এই তিন বছরে ভাইরাসটি যত বেশি ছড়িয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছড়িয়েছে বিভিন্ন রকমের কন্সপিরেসি থিওরি।
শুধু যে সোশ্যাল মিডিয়াতেই এসব নিয়ে চর্চা হয়ে এসেছে তা নয়, বিভিন্ন দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এসব কন্সপিরেসি থিওরি প্রচার করা হয়েছে। এসব কন্সপিরেসি থিওরি মেইনলি এসেছে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এবং ইরান থেকে। এসব দেশের গভমেন্ট ডিরেক্টলি এসবে ইনভলভড না থাকলেও, গভমেন্ট রিলেটেড কিছু ব্যক্তিই এগুলো মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিয়েছে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
চীন এবং ইরানের সন্দেহের তীর ছিল
আমেরিকার দিকে। চীনে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষজন ধুমিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে পোস্ট
করেছে এবং শেয়ার করেছে। তাদের দাবী চীনকে শায়েস্তা করার জন্যই আমেরিকা চীনে এই
ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।
শুধু সোশ্যাল মিডিয়াই না, একজন চীনা
কূটনীতিক পর্যন্ত তার টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি টুইটে সরাসরি এই ব্যাপারে ইনডিকেট
করেছেন। তার দাবী উহানে ২০১৯ এর অক্টোবর মাসে একটি স্পোর্টস কম্পিটিশনে অংশ নিতে
আসা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি দল এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
মুখপাত্র ঝাও লিজিয়িন টুইটারে মার্কিন একটি কংগ্রেস কমিটির সামনে সেখানকার সেন্টার
ফর ডিজিজ কন্ট্রোল হেড রবার্ট রেডফিল্ডের একটি শুনানির ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেন। ঐ
ফুটেজে রেডফিল্ড আমেরিকার কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা রিলেটেড মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন।
কিন্তু টেস্ট করে নাকি দেখা গেছে কোভিড-নাইন্টিনের কারণেই হয়েছে সেসব মৃত্যু।
যদিও মি রেডফিল্ড বলেননি কখন ঐসব
মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু চীনা ঐ কূটনীতিক টুইটারে ঐ ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করে ক্যাপশনে
লিখেছেন, "সিডিসি কট খেয়ে গেছে। আমেরিকায় কবে ফার্স্ট
পেশেন্ট মারা গিয়েছিল? কত মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়েছিল?
কোন কোন হাসপাতালে? তাই হতে পারে সেসব
মার্কিন সেনাদের মাধ্যমেই উহানে করোনা ভাইরাস এসেছিল। মানুষকে সত্যটা জানান।
আমেরিকার কাছে এর ব্যাখ্যা চাই।"
মিস্টার ঝাওয়ের সেই টুইট চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি সিসিটিভিতে প্রচার করা হয়। গ্লোবাল টাইমসেও পাবলিশ করা হয়। এছাড়াও, চীনের একাধিক সায়েন্টিস্ট দাবী করেছেন, করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক আকারে চীনের হাত ধরে ছড়ালেও, এই ভাইরাসের শুরুটা চীনে হয়নি। চীনের পাশাপাশি ইরানের ভেতরেও ব্যাপক পরিমাণে মানুষের বিশ্বাস করোনা ভাইরাস আমেরিকার তৈরি।
এমনকি ইরানের ইসলামিক
রেভল্যুশনারি গার্ডের কম্যান্ডার মেজর জেনারেল হুসেইন সালামি ডিরেক্টলি বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর
পেছনে আছে আমেরিকার হাত। তার মতে, আমেরিকা প্রথমে চীনে
এবং পরে ইরানের বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের মাধ্যমে জীবাণু-অস্ত্রের সন্ত্রাসী হামলা
চালিয়েছে।
তাঁর এই বক্তব্যের পরের দিনই
ইরানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মেম্বার হেশমাতোল্লাহ
ফাতালহাতপিশে বলেন,
"ট্রাম্প করোনা নিয়ে মিথ্যা কথা বলছেন...এটা কোনো সাধারণ
রোগ না, এটা ইরান এবং চীনের বিরুদ্ধে এক প্রকারের
হামলা।"
রাশিয়াতে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও
রাশিয়ান গভমেন্ট রিলেটেড বিভিন্ন মিডিয়ায় চীন এবং ইরানের এসব অভিযোগ এবং
কন্সপিরেসি থিওরি জোরেসোরে প্রচার করা হয়েছে। আবার রুশ বিভিন্ন মিডিয়ায় ভাইরাসটি
ছড়ানোর পেছনে ব্রিটেনকেও দায়ী করা হয়েছে।
স্পুটনিক রেডিওর একটি প্রোগ্রামে
বলা হয়েছে, ব্রেক্সিটের পরে বাজার খুলে দেওয়ার জন্য চীনকে বাধ্য করতেই ব্রিটেন এই
কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। দি বিগ গেম নামক রুশ একটি পপুলার টকশোতে ইগর নিকুলিন
নামক এক রুশ মাইক্রোবায়োলজিস্ট বলেন, ব্রিটেন-ই এই করোনা
'অস্ত্র' তৈরি করেছে। তিনি
ভাইরাস না বলে ডিরেক্ট অস্ত্র বলেন।
তার মতে ব্রিটেনের পোর্টান ডাউনে
একটি রিসার্চ সেন্টারে বহুদিন ধরেই বিভিন্ন রকম জীবাণু এবং রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি
করার কাজ চলে আসছে।" যদিও রুশ গভমেন্ট দাবি করেছে, এসব স্টেটমেন্টের
সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমেরিকার ভেতরেও করোনাভাইরাস
নিয়ে বিভিন্ন রকমের কন্সপিরেসি থিওরি ছড়িয়েছে। সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
বারবার বলেছেন, করোনা ভাইরাস চীনের কাজ, তারাই এর জন্য দায়ী।
ট্রাম্পের সাপোর্টার হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যক্তিই ডিরেক্টলি বলেছেন, করোনাভাইরাস চীন ইচ্ছা করেই তৈরি করেছে।
হোয়ান রাইট নামক ক্যালিফোর্নিয়ার এক পলিটিশিয়ান টুইট করেছিলেন, উহানের ল্যাবরেটরিতেই এই করোনাভাইরাস তৈরি করা হয়েছিল। তিনি আরো একটি বিস্ফোরণ স্টেটমেন্ট দেন। তার মতে উহানের সেই রিসার্চে নাকি চীনকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে বিল গেটস! পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে পড়ে টুইটটি ডিলিট করে দেন তিনি। তবে আমেরিকার উগ্র ডানপন্থী বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে করোনাভাইরাস নিয়ে কন্সপিরেসি থিওরির কোনো শেষ নেই। এই অবস্থা দেখে বিচলিত একদল সায়েন্টিস্ট মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন। যেখানে তারা বলেছিলেন, "জীবজন্তুর শরীর থেকেই এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। কন্সপিরেসি থিওরি মানুষের মনে শুধুই ভয়, গুজব এবং ঘৃণা ছড়াবে।"