“ডাইনি শিকার” আধুনিক ইউরোপের এক কালো অধ্যায় | Ugly History || Witch Hunts

Author
0

 


পোল্যান্ডের এক গ্রামে একটা আর্কিওলজিস্ট টিম মাটিতে খোঁড়াখুঁড়ি করছিলো প্রাচীন কিছু আবিষ্কারের আশায় হঠাৎ তারা এমন কিছু খুঁজে পায়, যা তাদের বেশ অবাক করেছিলো তার সপ্তদশ শতকের এক কঙ্কাল আবিষ্কার করেন কঙ্কালটির পা শিকল দিয়ে আটকানো ছিলো আর পাশেই ছিলো একটা প্রাচীন আমলের কাস্তে বা কাচি কঙ্কালটি ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা যায় এটি ছিলো একজন মহিলা আর কাস্তে এবং পায়ে শিকল দেখে ধারণা করা হয়, এই মহিলাকে হয়তো ডাইনি সন্দেহে খুন করা হয়েছিল

কিন্তু কেনো? আর তার চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়েই কি নিরপরাধ মানুষকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো! নাকি এর পিছনে ছিলো অন্য কোনো কারণ? শোনা যায় সেসময় নারীদের সাথে করে বিড়ালও মেরে ফেলা হতো, এর কারণ কি ছিলো?


পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন



১৪৮২ থেকে ১৭৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপ জুড়ে হাজার হাজার মানুষকে ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো যার বেশিরভাগই ছিলো নারী যদিওবা তাদের করা দোষের বেশিরভাগই কোনো প্রমান ছিলো না, তবুও সাধারণ মানুষগুলোকে মিছে কিংবা সন্দেহের কারণে দোষ দেওয়া হতো আর দোষী সাব্যস্ত করা লোকগুলোকে দুটো শর্ত দেওয়া হতো, এক. যদি সে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে তাহলে জনসম্মুখেই দেওয়া হবে ফাঁসি . যদি সে ফলস কনফেশন অর্থাৎ দোষ না করেও দোষ স্বীকার করে মাফ চায় তাহলে মিলবে মুক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোষ না করেও স্বীকার করতো

সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করার প্রবণতা ভয়ংকর রকম বেড়ে গিয়েছিল পশ্চিমের দেশগুলোতে গোটা ইউরোপে সেসময় লাখের মতো মানুষকে ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় যাদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় দেখা গেছে সেসময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কোনও একটি নারীকে ডাইনি সন্দেহে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা তখনকার সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সব নারীদের ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো, তারা ছিলো প্যাগানসংস্কৃতির ধারক বাহক প্যাগানদের ধর্মীয় রীতিনীতি এবং উপসনাপদ্ধতি খ্রিস্টধর্মের চেয়ে ছিলো একেবারেই আলাদা আর মূলত কারণেই প্যাগানদের খ্রিস্টধর্ম বিরোধী বলে এসব অভিযোগ তোলা হতো

 


*ডাইনি সন্দেহের কারণ

ইংরেজিউইচশব্দ অর্থাৎ আমরা বাংলায় বলি ডাইনি মূলত এটা এসেছেউইকাশব্দ থেকে এটি অনেক পুরনো একটি ইংরেজি শব্দ এই উইকা শব্দের প্রকৃত অর্থ হলোজ্ঞানী ব্যাক্তি প্রাচীন প্যাগান ধর্মের উপাসক নারী পুরুষদেরকেও উইকা বলা হয় এরা ঈশ্বরের পুরুষালি, মেয়েলি রূপের প্রার্থনা করতো আর এই ধারণাটি ছিল খ্রিস্টান ধর্মের মূল ধারণার একেবারেই বিরোধী আর এই ধর্মটি খ্রিস্টান ধর্মের উপরের লেভেলের ব্যাক্তিদের মাঝে একধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করে উইকান ধর্মের একটা বিশেষ দিক হচ্ছেউইচক্রাফট উইকা পরিভাষায় এর অর্থ হল: ‘জ্ঞানীদের শিল্প-কৌশল তবে খ্রিষ্টান ধর্মে এর অর্থ করা হয়; “ডাকিনীবিদ্যা খ্রিস্টধর্মের আগমনের আগে উইকানদের বেশ সম্মান ছিল কেননা এদের বিশেষ কিছু জ্ঞান ছিলো উইকান নারীরা তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে মানুষের রোগ বালাই সারিয়ে তুলত আর এই তন্ত্রমন্ত্রই খ্রিস্টানদের কাছে ছিলো কুসংস্কার একটা সময় ইউরোপের মানুষ উইকান নারীদের ভয় পেতে শুরু করে এর মূল কারণ হলো, উইকানরা এমন সব বিষয় জানত যা সাধারণ লোকে জানত না উদাহরণস্বরূপঃ- উইকান নারীরা জন্মের সময় সম্মোহনবিদ্যা প্রয়োগ করে গর্ভবতী নারীর যন্ত্রণা কমাতো অথচ বর্তমানে হিপনোটাইস বা হিপনোসিস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই যদিও এখন আর কেউ হিপনোসিসকে ভয় করে না যাইহোক, উইকানদের এমন জ্ঞানের পরিধি দেখে খ্রিস্টান চার্চ গুলো ভাবলো উইকানরা আসলে এসব গুপ্তবিদ্যা পেয়েছে শয়তানের কাছ থেকে খ্রিস্টানরা কেবল প্রার্থনায় বিশ্বাস করত যে কারণে উইকানদের ম্যাজিক কিংবা তন্ত্রমন্ত্র তারা সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে কেননা মধ্যযুগে অসুখ-বিসুখকে মনে করা হত ঈশ্বরের রাগ আর এর চিকিৎসা করা মানেই ছিলো ঈশ্বরের বিরোধিতা তথা খ্রিষ্টান ধর্মের বিরোধীতা ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ উইচক্রাফট অ্যাক্ট- বলা হলোঃ- “চিকিৎসার জন্য যদি কেউউইচদেরকাছে যায়, তাহলে তারাও ধর্মের চোখে সমান অপরাধী

 


খ্রিস্টধর্ম হলো, পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম উইকা ধর্মে নারীদের প্রাধান্য বেশি থাকাটা খ্রিস্টীয় যাজকদের অস্বস্তির আরেকটা কারণ এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি কারণে নারীদের ওপরে গির্জার যাজকদের বেশ ক্ষোভ ছিল মধ্যযুগে ইউরোপে গির্জার যাজকদের কাছে সৌন্দর্যের অর্থ হচ্ছে অশুভ”, সুখশান্তির অর্থ হচ্ছে পাপ”, যৌনতার অর্থ হচ্ছে অন্যায় তাদের চোখে সন্তান জন্মদানও ছিল বিরক্তিকর ব্যাপার আর সবই ছিলো নারী ঘটিত হিব্রু বাইবেলে, ঈভ অর্থাৎ বিবি হাওয়া স্বর্গে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার কারণেই মানবজাতির পতন ঘটে আর একারণে তারা মনে করতো, নারী পুরুষদেরকে পাপের পথে নিয়ে যায় আর এসবই গির্জার যাজকরা অন্ধ রকমভাবে বিশ্বাস করতো

 

*বিড়ালের সাথে ডাইনির কি সম্পর্ক?

পঞ্চদশ শতক থেকে উইকানদেরডাইনিঅভিযোগ দিয়ে পুড়িয়ে মারা শুরু হয় উইকানদের সবাই যে নারী ছিল তা নয় পুরুষও ছিল তবে তার ছিলো সংখ্যায় কম আর হা, উইকান নারীদের সাথে সাথে তাদের পালিত বিড়ালগুলোও পুড়িয়ে মারা হত কেননা, সেসময় খ্রিস্টীয় সমাজে প্রচলিত ছিল যে- বিড়াল হচ্ছে ডাইনিদের গুপ্তচর ধীরে ধীরে ইউরোপে বিড়ালের সংখ্যা কমে যায় বেড়ে যায় ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি আর ইঁদুর তো প্লেগ রোগের জীবাণু বহণ করে ফলে প্লেগের প্রকোপ বেড়ে যায় ব্যাপক হারে আর এই প্লেগের কারণ হিসেবেও দায়ী করা হয় উইকানদের

 


*শাস্তির নমুনা

অভিযুক্তদের ধরে এনে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো বর্তমান সময়ের রিমান্ডের মতো সেসময়েও সন্দেহভাজনদের কাছে তাদের সহযোগীদের নাম জানতে চাওয়া হতো উত্তর যদি বিচারকদের মন মতো না হতো তাহলেই চলতো নির্যাতন এরপর অভিযুক্তদেরকে দুটো শর্ত দেওয়া হতো, এক. যদি সে দোষ স্বীকার করে মাফ চায় তাহলে মুক্তি দেওয়া হবে যদি সে দোষ না করে থাকে, তাহলেও তাকে স্বীকার করতে হবে আর . যদি সে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে তাহলে জনসম্মুখেই তাকে দেওয়া হবে ফাঁসি এই শর্তের আগেও চলে নির্যাতন নির্যাতনের সাধারন একটা পদ্ধতি ছিলো, ঘুমাতে না দেওয়া টানা তিন দিন না ঘুমাতে দেওয়ার ফলে সন্দেহভাজন সেই ব্যক্তিরা হ্যালুসিনেশনে ভুগতে শুরু করতো এবং পরে যখন জিজ্ঞাসবাদের জবানবন্দি নেওয়া হতো, তারা তখন না চাইলেও নিজের দোষ অকপটে স্বীকার করতো কেননা তাদের তখন সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জ্ঞান থাকতো না তবে বিচারকরা সেসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতো না এছাড়াও অভিযুক্ত যে আসলেই ডাইনি অথবা জাদুকর কিনা! সে বিষয়েও কোনো প্রমাণ চাইতো না কেননা তারা জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করেই শাস্তির রায় দিতো ফলস্বরূপ অবচেতন মস্তিষ্কে দেওয়া সেসব স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করেই মানুষগুলোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হতো

ধারণা করা হতো, অষ্টাদশ শতকেই বিশ্বে ডাইনি নিধনের বর্বরতা সমাপ্ত হয়েছে কিন্তু ৩৬টি দেশে এখনো ডাইনি শিকার অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ক্যাথলিক মিশনারি সোসাইটি মিসিও৷

মতামত

0Comments

আপনার মতামত লিখুন (0)

#buttons=(ঠিক আছে!) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটি ব্যবহারে আপনার অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য কুকিজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমরা কখনই আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার কোনো ডাটা সংরক্ষণ করব না। আরো জানুন
Ok, Go it!