শীতের রাতে কাথামুড়ি দিয়ে দাদি-নানির কাছে ভূতের গল্প শোনা, প্রতি বৃহস্পতিবার রাত ১১ টা ৫৯ মিনিটে কানে হেডফোন গুজে রেডিও ফুর্তিতে আরজে রাসেল ভাইয়ের ভূত এফএম অথবা টিভিতে ঠাকুরমার ঝুলিতে পেটকাটা ভূত কিংবা শাকচুন্নিদের এপিসোডগুলো দেখা - এগুলো আমাদের অনেকের কাছেই ছোটবেলার প্রিয় স্মৃতি। মুসলিম সংস্কৃতি অনুযায়ী আমরা যেমন জ্বিনের বিশ্বাস করি, তেমনি বাংলার লোকজ বিশ্বাসেও রয়েছে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ভূত-পেত্নীর অস্তিত্ব।
ব্রহ্মদৈত্য
ব্রহ্মদৈত্য – নামটাতেই একটা ভাব আছে না? ওজনদার নামেই বোঝা যায় এরা ভূতেদের
সর্দার। হিন্দুরা বিশ্বাস করে ব্রাহ্মণ মরে ব্রহ্মদৈত্য হয়। এরপর পায়ে খড়ম চাপিয়ে,
সাদা ধুতি পড়ে খট খট শব্দে হেঁটে বেড়ায়। এরা মূলত বেলগাছ বা শিমুল গাছে থাকে। সাধারণত
এরা কারো ক্ষতি করে না। খুশি হলে পুরষ্কারও দেয়। কিন্তু রেগে গেলে আবার ঝামেলাও করে।
এরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। তাই অপরিষ্কার কেউ এদের পাল্লায় পড়লে কপালে শনি
আছে। ঘাড়টা মটকেও দিতে পারে কপাল বেশি খারাপ হলে।
পেত্নী
সহজ ভাষায় বললে ভূতের ফিমেল এডিশন হচ্ছে পেত্নী। সংস্কৃত ‘প্রেতনী’ থেকে
পেত্নী এসেছে। অল্পবয়সী, আনম্যারিড কোনো মেয়ে অপঘাতে মারা গেলে পেত্নী হয়। এরা তেঁতুল
আর শ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে নাকি সুরে কথা বলে আর মানুষকে বিরক্ত করে। তবে ইন্টারেস্টিং
দিক হচ্ছে অনেক জ্বিনের মতো তাদের পায়ের গোড়ালিও উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
শাঁকচুন্নি
ঠাকুরমার ঝুলি ও ফেইসবুকের মিম গ্রুপগুলোর কারণে শাঁকচুন্নি ও গোপাল খুবই
জনপ্রিয় দুটি চরিত্র। শঙ্খ বা শাঁখা চূর্ণী থেকে মানুষের মুখে ঘুরেফিরে শেষে এদের নাম
এসে ঠেকেছে শাঁকচুন্নিতে। অল্পবয়সী বিবাহিত নারীর অতৃপ্ত আত্মা পরিণত হয় শাঁকচুন্নিতে।
শাঁখা ও লালপেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে এরা পুকুর ঘাটে কিংবা গাছের ডালে বসে থাকে। সন্ধ্যার
পরে কোনো বিবাহিত নারী একা একা চুল খুলে এদের আশেপাশে আসলে, তার ভেতরে ঢুকে পড়ে এরা।
এরপর তার সুখের সংসার করতে থাকে সেই শাঁকচুন্নি। অনেক জায়গায় এদেরকে শাঁকিনী বলেও ডাকা
হয়।
নিশি
এরা খুবই ভয়ংকর ভূত। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে
আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে মানুষের নাম ধরে ডাকে। নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষজন
হিপনোটাইজড হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, এরপর আর কখনো ফিরে না। এজন্য গ্রামে-গঞ্জে
বলা হয় রাতের বেলা দরজায় কেউ নক করলে তিনবার নক করার আগে না খুলতে। কারণ নিশিরা নাকি
তিনবার নক করতে পারে না! কিছু কিছু তান্ত্রিক আবার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষেও
থাকে।
স্কন্ধকাটা
ছোটদের জন্য ঠাকুরমার ঝুলির সবথেকে ভয়ংকর ভূত এই স্কন্ধকাটা। এদের দেহের
উপর মাথা থাকে না। যাদের গলা কেটে মারা হয়, তারাই স্কন্ধকাটা ভূত হয়। সন্ধ্যার পরে
বাড়ির পেছনের জঙ্গলে এদেরকে দু’হাতে মাথা নিয়ে লোফালুফি করতে দেখা যায়। মজার ব্যাপার
হচ্ছে, কিছু কিছু স্কন্ধকাটা ভূতের মাথা হাতেও থাকে না। তারা নিজেদের মাথা খুঁজে বেড়ায়।
তবে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে এরা মানুষ দেখলে তার মাথা ছিঁড়ে নিজের মাথার জায়গায় লাগাতে
চায়।
কানাভোলা
গভীর নির্জন রাতে মানুষকে পেলে তার গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে
দেয় এই ভূত। মানুষটি তখন পথ হারিয়ে বার বার একই জায়গায় ফিরে আসে। ক্লান্তি ও ভয়ে একসময়
অজ্ঞান হয়ে যায়। কেউ কেউ মারাও যায়।
রাক্ষস
এরা বিশ্রি সব রোগে আক্রান্ত থাকে। এদের বিষ দাঁত থাকে। আঙুলগুলোতে লম্বা
লম্বা নখ থাকে। মানুষের মাংস এদের প্রধান খাদ্য। লোককথা থেকে জানা যায়, এরা নাকি মানুষের
গন্ধ পেলেই চিৎকার করে উঠত। ‘হাউ মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ’, ছোটবেলার এই কথাটি মনে
পড়ে? এরাই হলো রাক্ষস।
আলেয়া
রাতের বেলা জলাভূমিতে জ্বলতে থাকা একরকম আলো, অনেকেই একে ভূতের আলো বলে।
এলাকার মুরুব্বীদের মতে, যেসব জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় তারা আলেয়াতে পরিণত হয়।
এরা বাগে পাওয়া জেলেদের ডুবিয়ে মারে। আবার অনেকে বলে, আলেয়া হারিয়ে যাওয়া পথিকদের আলো
দেখিয়ে সঠিক পথে নিয়ে যায়।
মেছোভূত
বাংলার ভূতেদের ভেতর সবচাইতে লোভী ভূত। তার মাছ
এতই পছন্দ যে খালে-বিলে-পুকুরে নদীতে সে শুধু মাছ খেয়ে বেড়ায়। রান্নাঘরে এনে রাখা মাছকেও
ছাড় দেয় না। তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ ইলিশ মাছ। কেউ যদি রাত করে ইলিশ মাছ হাতে বাড়ি ফেরে,
রাস্তাতে অনুনয় করে মাছ চাইতে থাকে মেছোভূত। অনুনয়ে কাজ না হলে ভয় দেখিয়ে মাছ কেড়ে
নেয়।
শিকল ভূত
কমবয়সী বিবাহিত মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি অত্যাচার করে পানিতে
ডুবিয়ে মারে, তাহলে সে শিকল ভূতে পরিণত হয়। লম্বা লম্বা চুলকে শিকলের মতো ব্যবহার করে
এরা পানিতে থাকা মানুষের পা ধরে টান দেয়। যেসব পুকুরে মানুষ ঘন ঘন ডুবে মারা যায়, সেখানে
শিকল ভূতের গল্প থাকবেই থাকবে। বাংলার মানুষ শিকল ভূতকে গভীরভাবে বিশ্বাস করে।
যক্ষ
হেমেদ্রকুমারের যখের ধন নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাস ছিল। এই যখ বা যক্ষ খুবই
ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার। আগের যুগের কিপ্টা ও বড়লোকরা যক্ষের কাছে নিজেদের ধন-সম্পদ
জামানত হিসেবে দিয়ে যেত। সাথে একটি ছোট বাচ্চাকে আটকে রাখা হতো সেখানে। এরপর না খেয়ে
মারা যায় সেই বাচ্চাটি। মরার পরেই সেটি পরিণত হয় যক্ষে। এরপর সেই সম্পদ পাহারা দেয়।
সেই সম্পদের দিকে কেউ নজর দিলেই এরা হিংস্র হয়ে যায়।
পিশাচ
যখন গভীর রাত নেমে আসে, তখন এরা শ্মশান, কবরস্থানে ঘুরে বেড়ায় খাবারের সন্ধানে।
এরা গলাপঁচা মৃতদেহ খায়। তারা মানুষের হবহু নকল করতে পারে। দেখতেও খুবই জঘন্য এরা।
তাই তো কোনো মানুষ অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকলে তাকে পিশাচ বলে গালি দেওয়া হয়।
বোবা
উপরের বেশিরভাগ ভূতেই হয়তো সচেতন মানুষজন বিশ্বাস করবে না।
কিন্তু বাংলার ভূতেদের মধ্যে একটা ভূতকে সবাই বিশ্বাস করে। ইন্টারেস্টিং দিক
হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষই জীবনে একবার না একবার এদের খপ্পড়ে পড়েছে। বোবা মূলত এক
ধরণের জ্বিন। রাতের গভীরে একা ঘুমন্ত মানুষের উপরে এরা চেপে বসে। তখন হঠাৎ তার ঘুম
ভেঙ্গে যায়। অনেক চেষ্টা করেও নড়তে চড়তে পারে না। মুখ দিয়ে শব্দও বের করতে পারে
না। মনে হতে থাকে বুকের উপরে অনেক ভারী কিছু বসে আছে। অনেকে তো তার উপরে অথবা ঘরের
আশেপাশে ভয়ানক কিছু দেখতেও পায়। অনেকে আবার তাদের প্রিয়জনদের ভূত রূপে দেখতে পায়।
তবে কিছু সময় পর একা একাই বোবা কেটে যায়। সেভাবে কোনো ক্ষতি করে না এরা। তবে সেই
অল্পসময়েই এরা মারাত্মক ভয় পাইতে দিতে সক্ষম।