এই যে এক টুকরো মাঠ, যা নিয়ে এখনও ইনিয়ে বিনিয়ে এত কথা, তার বুকে নয়টি ছেলে খেলছে, তাদের কোনো দুঃখ নেই আজ। মাঠটি নিজেও আজ গর্বিত। কারণ তার বুকেই গড়ে উঠেছে বিশ্ব ফুটবলের নতুন তারকা। যে বাচ্চাগুলো ময়লা কাপড় আর ছেঁড়া জুতো পরে বলে কষে লাথি দিচ্ছে, নাগরিগের এত অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যেও তারা আজ অনেক খুশি। কারণ তাদের প্রিয় মোহাম্মদ সালাহ জন্মেছেন এখানেই। ফুটবলের শুরুটা করেছেন এই এবড়োথেবড়ো মাঠেই। নাগরিগের সালাহ থেকেই আজ লিভারপুলের সালাহ হয়ে ওঠার নতুন গল্প লিখেছেন মিশরের ইতিহাসের পাতায়।
ইউরোপীয়
ফুটবলের ঝাঁ চকচকে দুনিয়া থেকে দেখলে সালাহ’র উঠে আসার গল্পটা টের পাওয়া যাবে না।
তার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। নাগরিগের দুর্গন্ধময়, সরু মফস্বলের রাস্তায়। যে মাঠের কথা
বলা হল, সেখান থেকে সালাহর বাড়ি মিনিট দুয়েকের পথ।
নিস্তব্ধ সেই পথে হাঁটতে গিয়ে আপনি খানিকটা হলেও বুঝতে পারবেন তার আদর্শ
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, জিনেদিন জিদান আর ফ্রান্সিসকো
টট্টিদের অনুকরণ করতে কী সংগ্রামই না করেছেন তিনি।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
মিশরের ক্লাব "আরব কন্ট্রাক্টর স্পোর্টিং ক্লাব", ইয়থ একাডেমেরি জন্য প্রসিদ্ধ - সেখানে সালাহ ভর্তি হন ১৪ বছর বয়সে। এরপর প্রায় চার বছর পর ২০০৯/১০ মৌসুমে সিনিয়র ডেব্যু হয় ক্লাবের হয়ে। সালাহ আরব কন্ট্রাক্টরের হয়ে প্রথম গোল করেন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ক্লাব আল আহলির বিপক্ষে, আর তাতেই সালাহ চলে আসেন সবার নজড়ে। সেবছর জিতেন আফ্রিকারর সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার। আফ্রিকাতে দুর্দান্ত নৈপুণ্য তাকে নিয়ে আসে ইউরোপিয়ান ক্লাবের ফোকাসে। সুইস ক্লাব এফসি বাসেল মাত্র ২.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কিনে নেয় ২০ বছর বয়সী মোহাম্মদ সালাহকে। ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সেখানে ৭৯ ম্যাচ খেলে ২০ গোল এবং ১৭ এসিস্ট করেন সালাহ।
২০১৩-১৪
সিজনের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে তিনি নজর কাড়েন ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর।
শক্তিশালী চেলসির সাথে এওয়ে ম্যাচে সমতাসূচক গোল করে দলের ২-১ গোলে জয়ে ভুমিকা
রাখেন। ফিরতি লেগে তারই একমাত্র গোলে চেলসীকে আবারো পরাজিত করে বাসেল। সালাহ’র
অতিমানবীয় এই পার্ফমেন্সে মুগ্ধ হয়ে তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে চেলসী কোচ
হোসে মরিনহো।
সেই
সিজনেই সামার ট্রান্সফার উইনডোতে মোহাম্মদ সালাহকে দলে ভেড়ায় চেলসী। তারকাসমৃদ্ধ
চেলসী দলে জায়গা পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছিলো তার জন্য। বেশীরভাগ ম্যাচ
বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয়। নিজের সেরা টা দেয়ার সুযোগই হয়ে উঠে নি প্রথম সিজনে। এর
মধ্যেও যতোটা পেরেছেন নিজের সেরা টা দিয়েছেন। পরবর্তী সিজনে চেলসীর হয়ে লিগ জিতেন।
যদিও মাত্র তিন ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। পর্যাপ্ত খেলার সুযোগ না পাওয়ায়
তিনি কোচের সাথে কথা বলে লোনের আবেদন করেন। চেলসী থেকে ফিওরেন্তিনায় ১৮ মাসের জন্য
লোনে পাঠানো হয় তাকে।
সেখানে
অতিমানবীয় পার্ফমেন্সের বদৌলতে লোনের বদলে তাকে পার্মামেন্ট খেলোয়াড় হিসেবে দলে
ভেড়াতে চায় ফিওরেন্তিনা। কিন্তু এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে তিনি জয়েন করেন আরেক
ইতালিয়ান ক্লাব এ এস রোমায়।
এ
এস রোমায় যোগ দেয়ার পর যেনো মোহাম্মদ সালাহ আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেন। প্রায় প্রতিটি
ম্যাচেই তার উপর ভর করেই দল জিতে যাচ্ছিলো। প্রয়োজনীয় ম্যাচে গোল করার প্রবণতাই
তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছিলো। পুরো পৃথিবীকে তিনি ততোদিনে জানিয়ে দিয়েছেন তার
আগমণী বার্তা। সে সিজনেই ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন ১৫ গোল করে এবং সাথে
আরো ৬ টি গোল করিয়েছিলেন সতীর্থদের দিয়ে। এই অনন্য পার্ফমেন্সের কারণে সে বছর সিরি
আ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার এওয়ার্ডও জিতে নেন তিনি।
প্রকৃত
সালাহ কে দেখা তখনও বাকী ফুটবল বিশ্বের। পরের সিজনেই রোমা থেকে যোগ দেন ইংলিশ
ক্লাব লিভারপুলে। বাকিটা ইতিহাস। ইউর্গেন ক্লপ এবং মো সালাহর হাত ধরে লিভারপুল
ফিরিয়ে এনেছে তাদের হারানো ঐতিহ্য। ৩০ বছর পর জিতেছে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। জিতেছে
ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফিও। লিভারপুলের হয়ে ছয় সিজন খেলে ৩০৫ ম্যাচে করেছেন
১৮৬ টি গোল ও ৭৯ টি অ্যাসিস্ট।
আন্তর্জাতিক
ফুটবলেও রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ৫ গোল করে আফ্রিকান
দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। বিশ্বকাপে যেতে শেষ ম্যাচে জয়ের কোন বিকল্প
ছিলো না তাদের। কংগোর সাথে ম্যাচটির দিকে তাই তাকিয়ে ছিলো পুরো মিশর জাতিটি।
প্রথমে মোহাম্মদ সালাহ’র গোলেই এগিয়ে যায় মিশর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিড ধরে রাখতে
পারে নি তারা। গোল খেয়ে বসে। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এই ম্যাচে খেলার শেষ মুহূর্তে
পেনাল্টি পায় মিশর। পুরো জাতির প্রেসার তখন মোহাম্মদ সালাহ’র কাধে। তার একটি শটের
উপর নির্ভর করছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন লোকের হাসি-কান্নার ভবিষ্যৎ। শট নিতে কোন ভূল
করলেন না তিনি। গোলকিপার কে পরাস্ত করে ২-১ এ ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপের জন্য মিশর কে
কোয়ালিফাই করান।
ইজিপ্টের হয়ে ২০১১ তে ডেবিউ করার পর থেকে ৮৮ ম্যাচে ৪৯ গোল করে তাদের আলটাইম টপ স্কোরার এখন মো সালাহ। ফুটবল বিশ্ব মোহাম্মদ সালাহ কে কতোদিন মনে রাখবে তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, মিশরের মানুষের মনে যে তিনি আজীবন বেচে থাকবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে। শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও তাদের মুখে হাসি ফোটানো এই মোহাম্মদ সালাহ কে কখনো ভোলা সম্ভব না তাদের পক্ষে। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য্য। শুধুমাত্র এই খেলার মাধ্যমেই পুরো জাতি ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে আনন্দে মেতে উঠে।