১৯৬৩ সালের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে খুব দরিদ্র এক পরিবারে
তার জন্ম। মায়ের নাম ডেলোরিস জর্ডান, বাবার নাম জেমস আর জর্ডান। মোট ৫ ভাইবোনের সংসার
চালাতে শৈশব থেকেই হিমশিম খেয়েছিলেন তার বাবা-মা। তার বাবা জেমস একটি কোম্পানিতে সুপারভাইজার
হিসেবে কাজ করতেন। আর তার মা ব্যাংকের খুব ছোট একটি পদে কাজ করতেন। তবে তার মা ছিলেন
চমৎকার এক মহিলা। শৈশব থেকে অনেক কিছু তিনি মায়ের কাছ থেকেই শিখেছেন। বলা হয়ে থাকে
আজকের এই সফলতার পেছনে তার মায়ের অবদান সব থেকে বেশি।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এতগুলো ভাইবোন আর আর্থিক দৈন্য থাকার পরেও পারিবারিকভাবে তার
শৈশব ছিল আনন্দময়। সবাই একসঙ্গে খুব মজা করতেন। প্রাচুর্য না থাকলেও ভালোবাসার কমতি
ছিল না কারও মধ্যে। বাবাই তার মনে বাস্কেটবল খেলা নিয়ে প্রথম ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন।
তার বড় ভাই ল্যারি জর্ডান বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করতেন। তবে তিনি ছিলেন মাইকেলের থেকে
উচ্চতায় কম। বাবা ভাবলেন মাইকেলকে যদি ট্রেনিং দেওয়া যায় তবে সে হবে বিখ্যাত খেলোয়াড়।
আর সেই চিন্তা থেকে বাড়ির পেছনের আঙিনায় মাইকেলের জন্য তৈরি করে দেন ছোট্ট একটি বাস্কেটবল
গ্রাউন্ড। যেখানে বাবাই ছিলেন তার প্রশিক্ষক।
এমজের বয়স যখন মাত্র ১৫। তিনি তখন লেনি হাইস্কুলের ছাত্র। ততদিনে
বাস্কেটবল খেলায় বেশ নাম কুড়িয়েছেন তিনি। স্কুলের বাস্কেটবল টিমে সুযোগ পাওয়ার জন্য
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তিনি। অথচ দেখা গেল লিস্টে তার নাম নেই। কারণ হিসেবে বলা
বলা হয়, অন্য কন্টেন্ডারের থেকে তার উচ্চতা কম। কিশোর বয়সের সেই অভিমানে সিদ্ধান্ত
নিলেন যে তিনি খেলাই ছেড়ে দেবেন।
তবে তার মা তাকে সাহস জোগান। উৎসাহ দেন। স্কুলের জুনিয়র টিমে তাকে যোগদান করান। ব্যর্থতা আর হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে বিজয়ী হয়ে ফিরলেন তিনি। এমজের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে পরে স্কুলের সিনিয়র দলেও নিয়ে নেওয়া হয় তাকে। এর পরে তিনি অংশ নিয়েছেন নানা প্রতিযোগিতায়। সবখানেই বিজয়ীর বেশে ফিরেছেন তিনি।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি তখন ভর্তি হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব
নর্থ ক্যারোলিনা-তে। সময়টা তখন ১৯৮০ সাল। সেখানকার প্রধান কোচ ড্যান স্মিথ প্রতিভাবান
খেলোয়াড়দের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করলেন। আর সেখানে অংশ নিলেন মাইকেল
জর্ডান। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেন। তার উচ্চতা ছিল তখন
৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। তার ক্ষিপ্রতা, লাফানোর গতি, বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সেখানকার
সবাই। এরপর অংশ নিয়েছিলেন ম্যাকডোনাল্ড অল আমেরিকান গেমে। সেখানেও তিনি রেকর্ড পরিমাণ
পয়েন্ট পেয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে জর্ডান বলেন, কোচ ড্যান স্মিথ আমার কাছে বিশেষ কিছু।
তিনিই আমাকে বদলে দিয়েছিলেন।
এরপর ইউনিভার্সিটির টিমে যোগ দেন মাইকেল। আর যোগ দিয়েই অংশ
নেন একটি টুর্নামেন্টে। সেখানে তাদের খেলা পড়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। সেই
খেলায় জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে গেলে তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন একাই। আর চ্যাম্পিয়নের
ট্রফিটা এনে হাতে দিয়েছিলেন কোচ ড্যান স্মিথের কাছে। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে
হয়নি।
বাস্কেটবলের এক সুনিপুণ শিল্পী হিসেবে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া।
তার সম্পর্কে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ল্যারি বার্ড বলেন, আমাদের সময়ে আমরা ভূমিতে
খেলতাম বাস্কেটবল, এ সময় একজন এলেন, তিনি ভূমিতে শুধু নয়, আকাশেও খেলতেন, তার নাম মাইকেল
জর্ডান। মাইকেল জর্ডানের খেলা যেমন ছিল অসাধারণ, তেমনি ছিল তার নেতৃত্ব।
তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পর হঠাৎ করে অবসরের ঘোষণা দিলেন
তিনি। তবে আবারও দু’বছর পর ফিরে এলেন। ফিরে এসে আবারও একটানা তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন
করেন তিনি।
বাস্কেটবলে বিশ্বের সেরা লিগ যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএর জনপ্রিয়তার
পেছনেও রয়েছে তার নাম। বাস্কেটবলের ইতিহাসে জর্ডানের ব্যক্তিগত পয়েন্ট ৩২,২৯২। প্রায়
১৫ বছর এনবিএতে খেলে গেছেন তিনি। শিকাগো বুলস এবং ওয়াশিংটন উইজার্ডসের হয়ে খেলে তিনি
ছয়বার এনবিএর চ্যাম্পিয়নের তকমা গায়ে লাগিয়েছেন। ১৯৮৩ এবং ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
বেস্ট স্পোর্টসম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে জিতেছিলেন এনবিএর রুকি অব দি ইয়ার
অ্যাওয়ার্ড। তার দ্রুত লাফ দেওয়ার ক্ষমতা এবং লাফিয়ে দ্রুতই বল বাস্কেটে ডাংক করার
ক্ষমতার জন্য মাইকেল জর্ডান অল্পদিনের মধ্যেই ‘এয়ার জর্ডান’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বর্ণময় ক্যারিয়ারে এনবিএ’তে শেষ ম্যাচটা খেলেছেন জর্ডান ২০০৩
সালের ১৬ এপ্রিল ফিলাডেলফিয়ার বিপক্ষে। অনেক পুরস্কার আর সম্মাননায় অভিষিক্ত জর্ডান
ইএসপিএনের এক জরিপে ১৯৯৯ সালে নর্থ আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত
হন তিনি।
মাইকেল জর্ডান কর ছাড়া বছরে ১৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করেন।
যার সিংহভাগ আসে নাইকি এবং এয়ার জর্ডান ব্র্যান্ড থেকে। এছাড়া তার রয়েছে গেটোরেড এবং
হেন্সের সঙ্গে লাভজনক কিছু চুক্তি। তিনি নর্থ ক্যারিলিনার বাসিন্দা হিসেবে সেখানকার
এনবিএ দল শার্লট হর্নেটসকে কিনে নেন। বর্তমানে তার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ ২.৬
বিলিয়ন ডলার।
২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী তিনি সাবেক খেলোয়াড়দের মধ্যে সব থেকে
ধনী। তাছাড়া তার রয়েছে অনেক রেস্টুরেন্ট। সেখান থেকেও বড় একটা অংক তিনি আয় করেন। বিলাসবহুল
জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন তিনি। রয়েছে ব্যক্তিগত বিমান। যার দাম ৮৫ মিলিয়ন ডলার। ফ্লোরিডাতে
তৈরি করেছেন বিলাসবহুল এক বাড়ি। যা নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৭ মিলিয়ন ডলার। রয়েছে নিজেরই
একটি গলফ কোর্টও। মাছ ধরা খুব পছন্দ করেন তিনি। প্রায়ই তিনি বেরিয়ে পড়েন নিজের ফিশিং
বোটে করে।
মাইকেল জর্ডান, নাইকি এবং এয়ার জর্ডানের স্টোরি নিয়ে এই বছর
হলিউডে নির্মিত হয়েছে ‘এয়ার’ নামক মুভিটি। এতে অভিনয় করেছেন ম্যাট ড্যামন, বেন অ্যাফ্লেকের
মতো তারকারা। মাইকেল জর্ডানের চরিত্রে অভিনয় করেন ডেমিয়ান ইয়াং।