রুবিক’স কিউব সাধারণত ঘনকাকৃতির একটি
বস্তু। এতে ৬টি তল থাকে। আর প্রতিটি তল আবার ৯টি করে বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা থাকে। এই
বর্গগুলো ৬টি ভিন্ন ভিন্ন রঙে সাজানো থাকে। আর এই ক্ষুদ্র জিনিসটির বৈশিষ্ট্য এমন যে,
এর বর্গক্ষেত্রগুলোকে তাদের আপেক্ষিক অবস্থার পরিবর্তন না করেই একত্রে ঘোরানো যায়।
অসাধারণ এই জিনিসটি তৈরি করেছিলেন হাঙ্গেরিয় বংশোদ্ভুত ভাস্কর ও স্থাপত্য বিদ্যার অধ্যাপক
‘এর্নো রুবিক’। ত্রিমাত্রিক ডিজাইনের প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। ‘একাডেমি অব অ্যাপ্লায়েড
আর্ট এন্ড ক্রাফটে’ তিনি একজন ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতা পেশাটাই তার
অনেক পছন্দের। ক্লাসে শিক্ষার্থীদেরকেও তিনি তার আগ্রহের বিষয় স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে
পড়াতেন। সহজ করে কীভাবে তার শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়টা ভালো করে বোঝানো যায় এ নিয়ে সারাদিনই
ভাবতেন তিনি।
সময়টা ছিল ১৯৭৪ সাল। এর্নো রুবিকের বয়স তখন মাত্র ২৯। তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমটা ছিল এলোমেলো। রুবিক বিভিন্ন আকারের জিনিস নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। একদিন খেলার বশেই কিছু কাঠের টুকরো আঠা দিয়ে জোড়া লাগালেন। তারপর বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক আর ইলাস্টিক স্প্রিং দিয়ে বানিয়ে ফেললেন অদ্ভুত এক জিনিস। অনেকটা কৌতূহলবশতই ছোট কাঠের ব্লকগুলোকে এলোমেলোভাবে ঘোরাতে লাগলেন তিনি। কিছুক্ষণ ঘোরানোর পর যখন রঙগুলো এলোমেলো হয়ে যায় তখন তার দেখতে খুব ভালই লাগছিলো। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত রুবিক বোঝতেই পারেননি যে, তিনি কী বানিয়ে ফেলেছেন। অবাক হয়েই তিনি লক্ষ্য করলেন, এখন আর তিনি রঙগুলোকে মিলাতে পারছেন না। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর্নো রুবিকের কোনো ধারণাই ছিল না যে কিভাবে তিনি এটা সমাধান করবেন। তিনি মনে মনে সন্দেহ করতেন যে, আসলেই কি কেউ এটা সমাধান করতে পারবে? এর্নো রুবিক তো ধরেই নিয়েছিলেন যে, কেউ হয়তো এটি আর মেলাতেই পারবে না! তার নিজের এই রুবিকটি সমাধান করতে প্রায় এক মাসের মতো লেগেছিল।
যা-ই হোক, এই রুবিক’স কিউবের নাম কিন্তু প্রথমে রুবিক’স কিউব ছিল না। অধ্যাপক এর্নো রুবিক এর নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যাজিক কিউব’। এমনকি ‘আইডিয়াল টয়েস’ নামক কোম্পানি এর আরো কিছু নাম প্রস্তাব করেছিলো যেমন, দ্য গরডিয়ান নট, ইনকা গোল্ড। পরে অবশ্য রুবিক’স কিউব নামটিই নির্ধারণ করা হয়। তবে এর্নোর সেই রুবিক’স কিউবকে অনেক বাধা পেরিয়ে সফলভাবে এতদূর আসতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে রুবিক’স কিউব এর আইডিয়া এর্নোর মাথায় এলেও একে বাণিজ্যিকভাবে ১৯৭৭ এর দিকে তৈরি করা হয়। প্রথমে এটিকে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে খেলনার দোকানগুলোতে বিক্রি করা হয়। এরপর পশ্চিমা বিশ্বে একে বাজারজাত করার জন্য আমেরিকার ‘আইডিয়াল টয়েস’ কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। কিন্তু এটাকে জনপ্রিয় করা যায় কীভাবে?
এই চিন্তা থেকেই এর্নো রুবিক তার বন্ধু,
ব্যবসায়ী ‘টিবর লাজি’ কে অনুমতি দিলেন এটিকে জার্মানীর ‘নুরেমবার্গে’ খেলনা প্রদর্শনীতে
নিয়ে যাওয়ার জন্য। দেখা যায় সেখানে রুবিক’স কিউব ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে।
১৯৮০ সালের দিকে রুবিক’স কিউব জার্মানীর ‘গেম অব দ্য ইয়ার’ পদক লাভ করে। যেসব খেলায়
সুন্দর কনসেপ্ট, নিয়ম আর ব্যতিক্রমী ডিজাইন থাকে সাধারণত সেসব খেলাকে এ পুরস্কারটি
দেয়া হয়।
ধীরে ধীরে রুবিক’স কিউব ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। কারণ এটি অনেকটাই ধাঁধার মতো। আর বেশিরভাগ মানুষই সহজে এটি মেলাতে পারে না।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল, এই তিন বছরে প্রায়
২০০ মিলিয়ন রুবিক’স কিউব পুরো বিশ্বে বিক্রয় হয়। বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকা যেমন সায়েন্টিফিক
আমেরিকান, ওয়াশিংটন পোস্টে রুবিক’স কিউব নিয়ে লেখালিখি হতে থাকে। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের
১০টি বেস্ট সেলার বইয়ের ভেতরে তিনটি বই রুবিক’স কিউব নিয়ে লিখা। শুরু হয় রুবিক’স কিউব
সমাধান করার প্রতিযোগিতা। এমনকি গিনেস বুক অব রেকর্ডে সেসব ছেলেমেয়েদের নাম আসতে থাকে
যারা দ্রুত এটি সমাধান করতে সক্ষম হয়।
রুবিক’স কিউব সমাধান করা শিশুদের স্মৃতিশক্তি, ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এমনকি, এটি বাচ্চাদের প্রবলেম সলভিং এর দক্ষতাও বাড়িয়ে দেয়, যা খুবই প্রয়োজনীয় বাচ্চাদের মেধার বিকাশের জন্য। তবে যেকোনো কিছুরই যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি খারাপ দিকও থাকতে পারে। কোনো কিছুই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আসতে পারে ক্ষতিকর সম্ভাবনার। রুবিক’স কিউবও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে হতে পারে রুবিক্স রিস্ট, কিউবিস্ট থাম্ব সহ কিছু ক্ষতিকর শারীরিক সমস্যা, যেখানে রোগীর হাতের কব্জি এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিতে দেখা দেয় প্রচন্ড রকমের ব্যথা।
এর্নো রুবিকের সৃজনশীল মানসিকতা আর
ডিজাইনের প্রতি তার অধীর ভাল লাগাই হয়তো আমাদেরকে এনে দিয়েছে আজকের এই রুবিক’স কিউব
যা এখনো আমাদের অনেক তরুণ তরুণীর হাতে জায়গা করে নিয়েছে।