মোখা, হামুন ও মিধিলি। নিশ্চয়ই ভাবছেন এগুলো আবার কেমন নাম? এগুলো কোনো মানুষের নাম না। গত বছর বাংলাদেশের বুকে আছড়ে পড়া তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম। নরমালি বর্ষার শেষে শীত শুরু হওয়ার আগে বেশ কিছুদিন টানা বৃষ্টি হতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে ঘূর্ণিঝড়ও হয়। কিন্তু একই বছরে এরকম তিনটি ঘূর্ণিঝড় মোটেও স্বাভাবিক কিছু না। বরং প্রকৃতিবিদরা এর জন্য দায়ী করছেন এল নিনোকে। কি এই এল নিনো?
‘এল নিনো’ স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ ‘ছোট ছেলে’। মেইনলি
প্রশান্ত মহাসাগরের গরম পানিকে এল নিনো বলা হয়। এই ছোট ছেলে এল নিনোই বড় বিপদ বয়ে
আনছে। এন নিনোর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকের পানির তাপমাত্রা বেড়ে
গিয়েছে। স্বাভাবিকের তুলনায় অন্তত ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে পানির তাপমাত্রা। মহাসাগরের
পানি গরম হলে, তার প্রভাব পড়ে বায়ুমণ্ডলেও। আর এই প্রভাব শুধু
প্রশান্ত মহাসাগরে না, গোটা বিশ্বেই পড়ছে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এল নিনো একদমই আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। যা মেইনলি কয়েক
বছর পর পর হয়। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম বারের মতো
খেয়াল করেন এই গরম পানি। এরপর থেকেই দুঃস্বপ্নের মতো বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে
এই এল নিনো। ২০১৪-২০১৫ সালে এল নিনোর দাপট দেখা গিয়েছিল। যার কারণে ২০১৬ সালে
ব্যাপক মাত্রায় গরম পড়েছিল বিশ্বে। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে
সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা
হয়। এর কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে যায়। নরমালি দুই
থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো দেখা দেয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। আরও
একবার হাজির হচ্ছে এল নিনো। তাই বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা প্রেডিকশন দিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আরও একটি উষ্ণতম বছর পাবে পৃথিবী। অর্থাত্ ধীরে
ধীরে গরম বাড়তেই থাকবে। এবার প্রশ্ন হল, কতটুকু বাড়বে?
সেই শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে
ধীরে বাড়ছেই। তাই শিল্পবিপ্লব ঘটার আগের সেই সময়ের তাপমাত্রাকেই পরিমাপক হিসেবে
ধরে বর্তমানে তাপমাত্রা কতটুকু বাড়বে কিংবা কমবে সেই ব্যাপারে আন্দাজ পাওয়ার
চেষ্টা করেন এনভায়রনমেন্ট সায়েন্টিস্টরা। প্যারিস চুক্তিতেই বলা হয়েছিল, শিল্পবিপ্লবের আগের সময়কার অ্যাভারেজ টেম্পারেচারের চেয়ে কোনোভাবে যদি
২ ডিগ্রি সেলসিয়াস টেম্পারেচার বেড়ে যায়, তাহলে বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে
হবে পৃথিবীকে। তাই এতদিন তাদের প্ল্যান ছিল যে ভাবেই হোক, অ্যাভারেজ টেম্পারেচার যেন কোনও ভাবেই ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না পারে।
কমনওয়েলথ সায়েন্টিস্টরা এতদিন ভেবে এসেছেন কোনো ভাবেই ২১০০
সাল অথবা অন্তত ২০৮০ সালের আগে ১.৫ ডিগ্রি বা ২ ডিগ্রি টেম্পারেচার বাড়বেই না। অবস্থা
খুব বেশি খারাপ হলেও ২০৫০ সালের আগে তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিপর্যয় একদম নিকটে! কারণ, বিশ্ব আবহাওয়া
সংস্থা বলে দিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ১.৫ ডিগ্রির
তাপমাত্রার চৌকাঠ পার করে ফেলবে বিশ্ব। এমনকি, স্বাভাবিকের
থেকে ১.৮ ডিগ্রিও বেঁড়ে যেতে পারে টেম্পারেচার।
পৃথিবীর উষ্ণতা বেঁড়ে যাওয়ার অর্থ হল, এক্সট্রিম ইভেন্ট। অর্থাত্ চরম বিপর্যয়গুলো আরো বেশি বেশি ঘটবে। ঐযে
প্রথমেই যেমন গত বছর বাংলাদেশে ঘটে যাওয়ার তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা বললাম। এরকমই তাপপ্রবাহ,
খরা, দাবানল ইত্যাদি বেশি বেশি হতে দেখা
যাবে। আর দুর্যোগ ও বিপর্যয় মানেই মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি। বিশ্ব আবহাওয়ার সংস্থার এই
প্রেডিকশন শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, খামোখা ভয় দেখানো
হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? গত বছরই কিন্তু আমরা তা টের
পেয়েছি বেশ ভালোভাবেই। গত বছরের গরমে ফ্যানের নিচে বসেও ঘামতে হয়েছে। আর রাতের
বেলায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে তো রীতিমত হাঁসফাঁস ছুটে গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে
এই বছর তাঁর থেকেও বেশি গরম পড়বে!
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা, মেরু অঞ্চলের
তাপমাত্রা তিন গুণ বাড়তে পারে। ফলে বরফ গলবে। আর বরফ গললেই, সমুদ্রের পানি বাড়বে। তাতে আরও বিপদ বাড়বে। সুন্দরবনের মতো নিচু
এলাকাগুলি পানির নিচে চলে যাবে। গত বছর পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যার একমাত্র
কারণ কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি ছিল না। গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের কারণে পাকিস্তানের
পাহাড়ি অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছিল। বর্ষাকালে বৃষ্টি আর সেই বরফ গলা পানিই বিপদ
ডেকে এনেছিল।