গত কয়েক বছর ধরেই খরা, অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং তীব্র শীতে পৃথিবীবাসীর অবস্থা খারাপ। বিভিন্ন দেশে দেখা দিচ্ছে বন্যা, দাবানল ও ভূমিধসের মতো ন্যাচারাল ডিজাস্টার। স্পেশালিস্টদের মতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর পাশাপাশি এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব-ও এর জন্য দায়ী। কিন্তু এই এল নিনো আর লা নিনা আসলে কি?
‘এল নিনো’ স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ ‘ছোট ছেলে’। মেইনলি
প্রশান্ত মহাসাগরের গরম পানিকে এল নিনো বলা হয়। এই ছোট ছেলে এল নিনোই বড় বিপদ বয়ে
আনছে। এন নিনোর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকের পানির তাপমাত্রা বেড়ে
গিয়েছে। স্বাভাবিকের তুলনায় অন্তত ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে পানির তাপমাত্রা।
মহাসাগরের পানি গরম হলে, তার প্রভাব পড়ে বায়ুমণ্ডলেও। আর এই
প্রভাব শুধু প্রশান্ত মহাসাগরে না, গোটা বিশ্বেই পড়ছে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এল নিনো একদমই আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। যা মেইনলি কয়েক
বছর পর পর হয়। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম বারের মতো
খেয়াল করেন এই গরম পানি। এরপর থেকেই দুঃস্বপ্নের মতো বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে
এই এল নিনো। ২০১৪-২০১৫ সালে এল নিনোর দাপট দেখা গিয়েছিল। যার কারণে ২০১৬ সালে
ব্যাপক মাত্রায় গরম পড়েছিল বিশ্বে। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে
সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা
হয়। এর কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে যায়। নরমালি দুই
থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো দেখা দেয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। আরও
একবার হাজির হচ্ছে এল নিনো। তাই বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা প্রেডিকশন দিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আরও একটি উষ্ণতম বছর পাবে পৃথিবী। অর্থাত্
ধীরে ধীরে গরম বাড়তেই থাকবে। এবার প্রশ্ন হল, কতটুকু
বাড়বে?
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছে, মেরু অঞ্চলের
তাপমাত্রা তিন গুণ বাড়তে পারে। ফলে বরফ গলবে। আর বরফ গললেই, সমুদ্রের পানি বাড়বে। তাতে আরও বিপদ বাড়বে। সুন্দরবনের মতো নিচু
এলাকাগুলি পানির নিচে চলে যাবে। গত বছর পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যার একমাত্র
কারণ কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি ছিল না। গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের কারণে পাকিস্তানের
পাহাড়ি অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছিল। বর্ষাকালে বৃষ্টি আর সেই বরফ গলা পানিই বিপদ
ডেকে এনেছিল। এ তো গেলো এল নিনো এবং পৃথিবীর উপরে এর ইফেক্টের কথা।
এবারে আসা যাক লা নিনার ব্যাপারে। লা নিনাও স্প্যানিশ
শব্দ। এর অর্থ বালিকা বা ছোট মেয়ে। এটি এল নিনোর একদম বিপরীত। তবে এল নিনো হলে লা
নিনা হতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে সব সময় এল নিনোর পরপরই লা নিনা যে হবেই এমনটা
নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ ১৯৭৬-৭৭ সালের এল নিনোর পরে ৭৭-৭৮ সালে আবারো এল
নিনোর ঘটনা ঘটেছিল। এরপর লা নিনা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে।
আবহাওয়াবিদরা আর বিজ্ঞানীরা এল নিনোর কিছু লক্ষণ বের
করেছেন। সেগুলো হলো, ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া,
অস্ট্রেলিয়ার ভূপৃষ্ঠের চাপ বেড়ে যাওয়া। তাহিতি, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে বায়ুমণ্ডলের চাপ বেড়ে যাওয়া। অন্যদিকে, লা
নিনাতে পেরু এবং চিলির পূর্ব উপকূলে বিপুল পরিমাণে মাছ ও সামুদ্রিক জীব পাওয়া
যায়। কারণ তখন সেখানে সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রাণীদেরর জীবন ধারণের পক্ষে থাকে।
তবে এল নিনো ও লা নিনার কারণে পৃথিবীর সমগ্র আবহাওয়ায়
কিছু ব্যতিক্রম ঘটে। যেমন, আমেরিকার উত্তর দিকে এবং কানাডাতে শীতকালে গরম পড়ে!
আমেরিকার পশ্চিমে, পেরু ও ইকুয়েডরে গ্রীষ্মকালে ভারী
বৃষ্টিপাত হয়। এল নিনোর সময়ে আটলান্টিক সমুদ্রে হারিকেন ঝড়ের পরিমাণ অনেক কমে
যায়। এছাড়াও এটি সমুদ্রের লবণাক্ততাকেও ইনফ্লুয়েন্স করে।
গত ৫০ বছরে এল নিনো হয়েছে ১৬ বারেরও বেশি। অন্যদিকে লা
নিনা হয়েছে ১০ বার। তার আগের ৫০ বছরে এল নিনো হয়েছিল ১৪ বার এবং লা নিনা হয়েছিল ১২
বার। সর্বশেষ এল নিনো ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে শুরু করে ২০১০ সালের মে
মাস পর্যন্ত। অন্যদিকে, সর্বশেষ লা নিনা ২০১০ সালের শেষ থেকে এখনো পর্যন্ত চলছে।
অর্থাৎ পৃথিবী এখন অপেক্ষা করছে পরের এল নিনোর জন্যে। যার প্রভাবে তাপমাত্রা বেঁড়ে
যাবে মারাত্মক পরিমাণে। যা বাংলাদেশের জন্যে তো বটেই, সমগ্র দুনিয়ার জন্যেই একটি
দুশ্চিন্তার ব্যাপার।