সময়টা ১৯৯২ সাল। তিনজন তরুণ ছেলে ওঠে কোরিয়ার এক টিভি
ট্যালেন্ট কম্পিটিশনের মঞ্চে। কোরিয়ান লিরিক্স, ইউরো পপ, আফ্রিকান-আমেরিকান হিপ হপ এবং র্যাপের কম্বিনেশনে একদম নতুন স্টাইলের
গান পরিবেশন করে তারা। সাথে নাচও সুর ও তালের সাথে একদম খাপে খাপ। উপস্থিত
দর্শকদের মুহুর্তেই মাতিয়ে ফেলেন তারা। কিন্তু জাজদের খুব একটা পোষালো না তাদের
সেই পারফরম্যান্স। ব্যান্ডটি সেই রাতে সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে শো থেকে এলিমিনেট হয়ে
যায়। কিন্তু জাজদের সেদিনকার ডিসিশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখালো আমজনতা। কিছু দিনের
মধ্যেই ‘আই নো’ নামের গানটি টপ চার্টের একদম উপরে উঠে যায় এবং টানা ১৭ সপ্তাহ পর্যন্ত
শীর্ষে থেকে সব রেকর্ড গুড়িয়ে দেয়। সেই রাতের ব্যান্ডদল ‘সেও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ’
এর হাত ধরেই শুরু হয় একটি রেভোলিউশন। তাদের হাত ধরে শুরু হওয়া কোরিয়ান পপ বা কে-পপ
এখন মাল্টি-বিলিয়ন-ডলারের ইন্ডাস্ট্রি।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
২০১২ সালে বিশ্ব তোলপাড় করে দেওয়া সাইয়ের গ্যাংনাম
স্টাইলের কথা মনে আছে? যেটা ইউটিউব ভিউয়ের দিক থেকে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল। সেটি
কিন্তু একটি কে-পপ পারফর্ম্যান্স ছিল। কে-পপ ইউনিভার্স থেকে প্রথম সবথেকে বড়
ধাক্কা এই গ্যাংনাম স্টাইলই ছিল।
কে-পপ আইডলদের সবথেকে বড় গুণ হচ্ছে তারা কঠোর নিয়মানুবর্তী
ও পরিশ্রমী হয়ে থাকে। কে-পপ নিয়ে রিসার্চ করা হ্যান ওয়েইট নামক আমেরিকান এক
স্টুডেন্ট ২০১৪ সালে বলেছিলেন, “একজনের পোস্ট করা একটা কে-পপ ভিডিওর প্রোডাকশন, রঙ, শব্দ সবকিছু দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়।”
তিনি কে-পপ ব্যান্ডগুলোর ব্যাপারে আরো গভীরে রিসার্চ করতে গিয়ে দেখতে পান, সেখানে
শিশুদেরকে বেছে এনে নিয়োগ করা হয়। যারা খুব অল্প বয়সেই পরিশ্রম শুরু করে। ১০ থেকে
১৪ বয়সের কাউকেও কে-পপ আইডল হিসেবে সিলেক্ট করা হতে পারে। এজেন্সির কোনো লোক হয়তো
কোনো শপিং মলে কাউকে দেখেছে এবং তাদের কাছে মনে হয়েছে শিশুটি দেখতে সুন্দর, ব্যস!
তারা তাকেই আইডল হিসেবে গড়ে তুলবে। মেইনলি তিনটি বড় এজেন্সি আছে যাদের প্রত্যেকটির
২০০ এরও বেশি এরকম পটেনশিয়াল আইডল আছে। সবগুলো কে-পপ ব্যান্ডকেই এসব প্রসেসের মধ্য
দিয়েই আসতে হয়। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবস্যায়ের রেজাল্ট হিসেবেই
দুনিয়া মাতানোর এবং বিশাল ফ্যানবেজের ভালোবাসার যোগ্য করে তোলেন নিজেদেরকে।
কে-পপের আরো একটি বড় গুণ হচ্ছে তরুণ সমাজে বিশাল
ইনফ্লুয়েন্স ফেলার মাধ্যমে ইভেন কোরিয়ান গভমেন্টকে হাত করে ফেলা। ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াং লী তার রিসার্চে দেখেছেন তরুণ প্রজন্ম
সবথেকে বেশি কথা বলে হয় কে-ড্রামা অথবা কে-পপ নিয়ে। কোরিয়ান গভমেন্ট তাই কে-পপকে
ওয়ার্ল্ড মার্কেটে আরো বেশি পপুলার করে ফেলার জন্য মিউজিক ফিল্ডকেই রীতিমত ট্যাক্স
ফ্রি করে দিয়েছে। যা বিশাল এক ব্যাপার। এত বড় ইম্প্যাক্ট কিন্তু কে-পপের জন্যই
সম্ভব হয়েছে। এবং তাদের এই পদক্ষেপ কিন্তু কাজেও লেগেছে। কোরিয়াতে বড় বড় বিজনেসও
এসেছে এই উপায়ে। ইয়াং লি বলেন, এখানে ইনফ্লুয়েন্সটা শুধুই ইকোনমিক না, বাইরের দেশে
কোরিয়ার জনপ্রিয়তা এবং ইনডিরেক্ট ইনফ্লুয়েন্স করার ক্ষমতাও আরো বেড়েছে এতে করে।
এছাড়াও বিউটি ইন্ডাস্ট্রিও এখন অনেকটাই কে-পপের উপরে
নির্ভরশীল। কসমেটিকস, প্লাস্টিক সার্জারিসহ আরো অনেক সৌন্দর্যবর্ধক সার্ভিসের
ব্যবসা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে কে-পপ আইডলদের লাইফস্টাইল এবং পার্সোনালিটি।
কে-পপের আরো একটি ভালো দিক হচ্ছে মিউজিকের সাথে তাল মিলিয়ে
তাদের নাচ। তাদের নাচের কোরিওগ্রাফি ভক্তদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। এছাড়াও
আইডলদের সৌন্দর্য ও ফিটনেস তো আছেই। স্পেশালি বিটিএস এবং ব্ল্যাক পিংক আসার পর
থেকে কে-পপ ফ্যানরা রীতিমত উন্মাদ হয়ে গেছে তাদের প্রতি মুগ্ধতায়। তাদের গান এবং
চমৎকার ভিজুয়াল উপস্থাপনায় ভক্তরা রীতিমত অবসেসড। বিটিএস এবং ব্ল্যাকপিঙ্ক শেষ
পর্যন্ত বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় ব্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও কোরিয়ার ট্যুরিজমেও বিশাল বুস্ট এনে দিয়েছে এই
কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী কোরিয়ায় ঘুরতে যাওয়া প্রতি ১৩ জন
ট্যুরিস্টের মধ্যে এক জন আসে শুধুমাত্র কে-পপের জন্য। এছাড়াও ইকোনমিক দিক দিয়ে
বিশাল এক ইমপ্যাক্ট ফেলেছে তারা। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী শুধু বিটিএস একাই সাউথ
কোরিয়ার ইমোনমিতে যোগ করেছে ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! ক্যান ইউ বিলিভ ইট?
আরও বড় ব্যাপার হচ্ছে এটি আগামী ১০ বছরে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে! যা
কিনা ২০১৮ সালের অলিম্পিকের আয়ের থেকেও বেশি! এটি কিন্তু অনলি বিটিএসের কথা বলা
হচ্ছে। এছাড়াও আছে ব্ল্যাক পিংকসহ আরো কত কত কে-পপ ব্যান্ড। এবার বুঝুন অবস্থা!
এছাড়াও কে-পপের আরও একটি ভালো দিক হচ্ছে, এটি পৃথিবীর
বিভিন্ন কোণা থেকে ডাইভার্স একটি ফ্যানবেইজ তৈরি করেছে। যার কারণে তাদের মধ্যে
একটি ইউনিটি তৈরি হয়েছে। যারা সবাই কে-পপ মিউজিক এবং পারফর্ম্যান্সের প্রতি
ভালোবাসার থ্রুতে কানেক্টেড।