পুতুল জিনিসটার প্রতি আমাদের ফিলিংস খুবই কন্ট্রাডিক্টোরি। জিনিসটা বাচ্চাদের খুবই পছন্দের। আবার কিছু কিছু পুতুল দেখলেই অজানা একটা আতঙ্ক ভর করে মনে। ছোটবেলায় হিন্দি সিনেমা ‘খিলোনা বানা খালনায়াক’ এর পুতুল ভূত তাতিয়া ভিঞ্চু কিংবা ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘পুতুলের প্রতিশোধ’ এর সেই ভূতুড়ে পুতুল দেখে আমরা অনেকেই হয়তো ভয় পেয়েছি। অথবা হলিউডের চাকি থেকে শুরু করে হাল আমলের অ্যানাবেল পুতুলগুলোও হন্টেড পুতুল হিসেবে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নাম্বার এইট – ওকিকু
১৯১৮ সাল। ঘটনাটি ঘটে জাপানের হোক্কাইডো
প্রোভিন্সে। একটি ছেলে তার দুই বছর বয়সী বোন ওকিকুকে একটি পুতুল গিফট করে। ৪০ সেন্টিমিটার
লম্বা সেই পুতুলটি দেখতে ছিল একদম জাপানি মেয়েদের মতোই। পরনেও ছিল জাপানের ঐতিহ্যবাহী
পোশাক। পুতুলটি ওকিকুর খুবই পছন্দ হয়। সে সারাদিন সেটি নিয়েই পড়ে থাকতো। ওকে সুন্দর
করে সাজাতো, ওর সাথে খেলতো। কিন্তু আনফর্চুনেটলি পরের বছর ওকিকু মারা যায়। এর পর থেকেই
তার পরিবারের লোকজন নোটিস করতে থাকে, সেই পুতুলটির চুল লম্বা হচ্ছে জীবন্ত কোন মেয়ের
মতো। তখন পুতুলটিকে তারা ইওয়ামিজাওয়া শহরের মান্নেনজি টেম্পলে রেখে আসে। ১৯৩৮ সালে
তারা সেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু পুতুলটি থেকে যায় ঐ মন্দিরেই। তাকে নিয়ে ছড়িয়ে
পড়তে থাকে বিভিন্ন রকমের ভৌতিক গল্প। ঐ এলাকার লোকজন বিশ্বাস করে, শিশু ওকিকুর আত্মা
ভর করেছে সেই পুতুলের ভেতরে। তাই সেই ভূতুড়ে পুতুলটির নামই তারা রেখে দেয় ওকিকু। গুজব
আছে প্রতিবছর ওকিকুর চুল বড় হয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসে। কেটে দিলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই
আবার হাঁটু ছুঁয়ে ফেলে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
নাম্বার সেভেন – লেটা
১৯৭২ সালের এক রাত। হুট করেই হন্টেড
হাউজ দেখার ভূত চাপলো কেরি ওয়ালটনের মাথায়। পরিত্যক্ত এক হন্টেড হাউজে গিয়ে তার নজরে
আসে একটি পুতুল। অতশত না ভেবেই পুতুলটাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। সেই পুতুলটির নাম
ছিল লেটা। লেটাকে ‘ডল অফ ব্যাডলাক’ মনে করা হয়। এই পুতুলটিকে দেখলেই নাকি জীবনে ঘটতে
থাকে নানা দুর্ঘটনা। ধারণা করা হয়, লেটার বয়স ২০০ বছরের কাছাকাছি। কোনো এক রোমানিয়ান
লোক তার ছেলেকে উপহার দেওয়ার জন্য তৈরি করেছিল এই পুতুল। একদিন পানিতে ডুবে মারা যায়
তার সেই ছেলেটি। এরপর থেকেই নাকি সেই ছেলেটার আত্মা ভর করেছে লেটার ভেতরে। ইন্টারেস্টিং
ব্যাপার হচ্ছে, লেটার মাথায় সত্যিকার মানুষের চুল ব্যবহার করা হয়েছিল। পুতুলটিকে দেখলেই
নাকি খ্যাপাটে আচরণ করে কুকুর-বিড়ালরা। আবার অনেকে জানিয়েছেন, একে দেখার পরে অনেকেই
ডিপ্রেশনে ভুগেছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে জার্মানির
এক এন্টিক ব্যবসায়ী এই পুতুলটিকে খুঁজে পায়। তিনি পুতুলটিকে সাথে করে তার বাড়িতে নিয়ে
যান। এরপর থেকেই সেই লোক প্রতিরাতে একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একটি বাচ্চা
মেয়েকে জঘন্যভাবে হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিদিন রাতে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে তিনি মানসিকভাবে
ভেঙ্গে পড়েন। একটি প্যারানরমাল এক্সপার্ট টিমকে তিনি ডেকে পাঠান তার বাড়িতে। সেই টিম
এসে চমকপ্রদ এক তথ্য বের করে। প্ল্যানচেটে বসে পুতুলটির সাথে টানা ৩ ঘন্টা কথা বলে
তারা জানতে পারে, লেটা নামক একটি মেয়েকে নৃশংসভাবে মারা হয়েছিল। একদম হুবহু যেমনটা
তিনি প্রতিরাতে দুঃস্বপ্নে দেখতে পান! সেই মেয়েটিরই খেলার সঙ্গী ছিল এই পুতুলটি।
নাম্বার সিক্স – পুলাউ উবিনের হন্টেড বার্বি ডল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘটনা। বৃটিশ
আর্মিরা সিঙ্গাপুরে স্পাই সন্দেহে এক জার্মান কাপলকে আটক করে। সেই সময় সাথে থাকা তাদের
বাচ্চা মেয়েটি পালিয়ে যায়। কিন্তু পুলাউ উবিন শহরের একটি বাঁধের কিনারা থেকে পড়ে গিয়ে
তার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এলাকার মানুষেরা তার স্মৃতিতে একটি মন্দির তৈরি করে। সেখানে
একটি বার্বি ডলকে গলার মালা ও মাথার মুকুট পড়িয়ে দেবীতে রুপ দেয়। ধারণা করা হয়, সেই
পুতুলটির ভেতরে সেই মেয়েটির আত্মা আছে। অনেকে বলে সেই মন্দিরটি ও পুতুলটি ভূতুড়ে। মাঝে
মাঝেই নাকি রাতের বেলা তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তবে এলাকাবাসী বিশ্বাস করে এটি তাদেরকে
দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করে। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা এই পুতুলটিকে ঘিরে একটি
ফেস্টিভাল আয়োজন করে।
নাম্বার ফাইভ – ম্যান্ডি
ম্যান্ডি পুতুলটির ইতিহাস এখনো এক রহস্য।
তবে ধারণা করা হয় এটি ইংল্যান্ড কিংবা জার্মানির কেউ বানিয়েছিল ১৯১০-১৯২০ সালের মধ্যে
কোন এক সময়ে। এটি মূলত বাচ্চাদের জামা ও স্কার্ফ পড়ানো একটি বেবি ডল। ১৯৯১ সালে একে
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কুয়েস্নেল মিউজিয়ামে রাখা হয়। অনেকের মতে ম্যান্ডির প্যারানরমাল
ক্ষমতা আছে। তার চোখের চাহনীও বেশ ভয়ানক। তার কোলে একটি খেলনা ভেড়া দেখা যায়। মিউজিয়ামে
ঘুরতে আসা অনেকে দাবী করেছে তারা সেই খেলনা ভেড়াটিকে পুতুলটির কন্টেইনারের বাইরেও দেখেছে।
অনেকে আবার বলেছেন, তারা মিউজিয়ামের যেখানেই যায় সেখান থেকেই নামি মনে হয় ম্যান্ডি
তাদের দিকে তাকিয়ে আছে! মন্টেল উইলিয়ামসের শোতে দেখানোর পরেই এই পুতুলটি ব্যাপক পরিচিতি
পায়।
নাম্বার ফোর – দি আফ্রিকান ফেটিশ মার্কেট
আকোদেসসাওয়া ফেটিশ মার্কেট। এটি মূলত
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগোর রাজধানী লোমের একটি খোলা বাজার। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার
হচ্ছে এই বাজারটি ভূতুড়ে পুতুল ও রহস্যময় খেলনায় ভর্তি। মূলত টোগোর বিখ্যাত ভুডু ধর্মের
ম্যাজিকাল রিচুয়ালের জন্য এই অভিশপ্ত ও পবিত্র জিনিসগুলো ব্যবহার করা হয়। এটি পৃথিবীর
সবথেকে বড় ভুডু মার্কেট। এই বাজারটি বানরের মাথা, বিভিন্ন প্রাণীর খুলি, বিভিন্ন অভিশপ্ত
মূর্তি, মরা পাখি, ডেমোনিক সিরাপ, কুমিরের চামড়ার মতো অদ্ভুতুড়ে জিনিসে ভর্তি। এমনকি
সেখানে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলার সিরাপ, জাদুকরী আংটি, বোতলে ভর্তি আত্মা, এমনকি আটকে
রাখা জিনও পাওয়া যায়!
নাম্বার থ্রি – লিলি
অ্যামেরিকান একটি প্যারানরমাল রিসার্চ
অর্গানাইজেশনের এক কর্মচারী একদিন সকালে দরজা খুলে আবিষ্কার করেন একটি পুতুল। সাথে
রাখা একটি চিঠি। সেখানে লেখা, “আমি একদিন আমার দরজার বাইরে এই পুতুলটি খুঁজে পাই। পুতুলটির
সাথে একটি চিঠিতে লেখা ছিল এটিকে কখনো আয়নার সামনে রাখবেন না। এবং আপনি যেই ঘরে ঘুমাবেন
সেখানে একে রাখবেন না। আমি এই নিয়মগুলো মেনেই একে ঘরে এনে রাখি। কিন্তু আমার বিড়ালকে
কোনভাবেই এর কাছে আনা সম্ভব হচ্ছিলো না। আমার কুকুরটি শুধু দূর থেকে এর দিকে তাকিয়ে
থাকতো। মাঝে মাঝে আমি ঘুম থেকে উঠে টোস্ট পোড়ার গন্ধ পেতাম। মাঝে মাঝে ফলের মিষ্টি
গন্ধও পেতাম। ওহ, আরেকটা কথা, এই পুতুলটির প্রিয় রঙ লাল। ওর সম্পর্কে এর বেশি আর কিছুই
আমি জানি না।”
ঘটনাটিতে সেই অর্গানাইজেশনের হর্তা-কর্তারা
খুবই অবাক হয়। তবে তারা পুতুলটি নিজেদের কাছে রেখে দেয়। ধীরে-ধীরে এর কারণে সেই অর্গানাইজেশনে
এক্সট্রিম পর্যায়ের প্যারানরমাল ভাইবস তৈরি হতে থাকে। বেশ কিছু ভূতুড়ে ঘটনারও সাক্ষী
হয় তারা। কিন্তু এতে ভড়কে না গিয়ে, তারা একটি চমৎকার বুদ্ধি বের করে। তারা একে ব্যবসায়িক
উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। অরিজিনাল সেই পুতুলের আদলে ম্যাস প্রোডাকশন করতে
শুরু করে। সাথে করে এই পুতুল রিলেটেড ভূতুড়ে গাল-গল্পগুলোও ছড়িয়ে দেয়। এতে করে রাতারাতি
পপুলার হয়ে ওঠে পুতুলটি। এখন আপনি চাইলেও এরকম একটি ‘লিলি’ পুতুলের মালিক হতে পারবেন।
যদি সাহসে কুলায় আরকি।
নাম্বার টু – রবার্ট দ্য ডল
১৯০০ সালের ঘটনা। আমেরিকার “ইটন স্ট্রিট”
এলাকায় থাকত ‘ওটো’ নামের এক পরিবার। এই পরিবারের সবচেয়ে খুদে সদস্য ছিল ‘ইউজিন রবার্ট’।
ইউজিনকে ভালবেসে সকলে জিন বলে ডাকতেন। তাঁদের বাড়ির এক চাকর একদিন ইউজিনকে নিজের হাতে
তৈরি করা একটি পুতুল উপহার দেয়। পুতুলটি ইউজিনের এতই পছন্দ হয়েছিল যে, সে নিজের নামেই
পুতুলের নাম রেখে দেয় “রবার্ট”। জিনের সব সময়ের সঙ্গী ছিল সেই পুতুলটি। কিন্তু সেটি
সাধারণ কোন পুতুল ছিল না। হঠাৎ করেই এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতো। পরিবারের
লোকজন দাবী করতো, তারা ইউজিনকে প্রায়ই পুতুল রবার্টের সাথে কথা বলতে দেখতো। ১৯৭৪ সালে
ইউজিন মারা গেলে তার পরিবার পুতুলটিকে ‘ইস্ট মার্টেলো মিউজিয়ামে’ রেখে আসে। অনেকেই
এই পুতুলটিকে দেখতে আসে। অবাক করা ব্যাপার হলো, যখনই কেউ রবার্টের ছবি তুলতে চাইতো,
তখনই নাকি তাদের ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যেত। এরপর থেকে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ একটি ওয়ার্নিং
বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। সেখানে লেখা – ‘রবার্টের পারমিশন ছাড়া ছবি তুলবেন না। এবং ভুলেও
তাকে অসম্মান করবেন না। তার একটা বদঅভ্যাস আছে। কেউ তার সাথে বাজে আচরণ করলে সে তাকে
মনে রাখে। এবং মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে তাকে খুঁজে বের করে তার ক্ষতি করে।’
বিখ্যাত হরর সিনেমা ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘চাকি
ইউনিভার্স’ এর চাকি চরিত্রটি মূলত রবার্টের থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়েই বানানো।
নাম্বার ওয়ান – অ্যানাবেল
ভূতুড়ে পুতুলদের নিয়ে যদি কোন কিংডম
থাকতো, তাহলে সেখানকার রানী থাকতেন অ্যানাবেল। পৃথিবীর ইতিহাসের মোস্ট হন্টেড ডল বলা
হয় অ্যানাবেলকে। জনমনে সেই ধারণা আরো পোক্ত করে দিয়েছে জেমস ওয়্যানের কনজিউরিং ইউনিভার্সের
সিনেমাগুলো।
১৯৭০ সালের শীতকাল। ইউএস এর কানেকটিকাটের
একটি পরিবারের গল্প। নার্সিং পড়ুয়া মেয়ে ‘ডোনা’কে জন্মদিনে একটি পুতুল উপহার দেয় তাঁর
মা। সেই পুতুলটির নাম ছিল 'অ্যানাবেল'। ডোনার হোস্টেলের রুমমেট ছিল ‘এনজি’। প্রথম দেখাতে
পুতুলটিকে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি কারও। কিন্তু কয়েক দিন পর থেকেই নাকি ধরা পড়তে
শুরু করে কিছু অদ্ভুত ঘটনা। ডোনা কলেজে যাওয়ার আগে বিছানায় রেখে যেত অ্যানাবেলকে। হোস্টেলে
ফিরে এসে দেখত সেটি সোফায় বসে আছে। কিন্তু এনজিকে জিজ্ঞেস করলে সে জানাতো অ্যানাবেলকে
সে ধরেই নি। পর পর এরকম আরো অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। এক দিন ডোনা ও এনজি দুজনেই ঠিক
করে পুতুলটিকে সোফার উপরে বসিয়ে রেখে একসাথে হোস্টেল থেকে বের হবে। কিন্তু সেদিনও ফিরে
এসে পুতুলটিকে অন্য জায়গায় পড়ে থাকতে দেখে তারা। এরপর ডোনা তার পরিবারকে ব্যাপারটা
জানায়। তারা বিখ্যাত প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর ওয়ারেন দম্পতিকে খবর দেয়। তারা এসে রুদ্ধস্বাস
এক অভিযানের পরে আসল ঘটনা বের করতে সক্ষম হয়।
অনেক আগে অ্যানাবেল নামক একটি মেয়ের
ট্র্যাজিক মৃত্যু ঘটে। তার বাবা ছিল একজন পুতুল কারিগর। তিনি তার মেয়ের স্মরণে এই পুতুলটি
বানিয়েছিলেন। অ্যানাবেলের সেই অতৃপ্ত আত্মা এসে ভর করেছিল পুতুলটির উপরে।
এরপরে ওয়ারেন দম্পতি অ্যানাবেল পুতুলটিকে
নিয়ে তাদের ওয়ারেন্স অকাল্ট মিউজিয়ামে রাখেন। তারা তাদের ক্যারিয়ারে প্রচুর ইনভেস্টিগেশন
করেছেন। সবগুলো ঘটনা থেকেই একটি করে স্যুভেনির এনে সেই মিউজিয়ামে রাখতো তারা। এত অদ্ভুত
সব ভূতুড়ে জিনিসে মিউজিয়ামটি ভর্তি ছিল যে সেখানে সবসময় তালা মেরে রাখতো তারা।