রহস্যময় মায়া সভ্যতার অদ্ভুতুড়ে রীতিনীতি । Shadows of the Serpent

Author
0

 

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের কথা। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগের কথা আর কী। এই সময়কার অদ্ভুত কিছু পান্ডুলিপি আর ফলক আবিষ্কৃত হলো আধুনিক পৃথিবীতে, চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেলো। কোনো অক্ষর-বর্ণের বালাই নেই, কেবল কিছু ছোট ছোট ছবি পাশাপাশি এঁকে যেন কিছু একটা লেখার চেষ্টা। আস্তে আস্তে নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণায় পৃথিবীর এক অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস আলোর মুখ দেখতে পেল, যা এই মায়ান সভ্যতা। শুনলে অবাক বনে যেতে হয় এমন সব ইতিহাস মায়ানদের। ৪০০০ বছর আগে যখন পৃথিবীর অনেক প্রান্তে মানুষ সভ্যও হতে শেখেনি, স্থায়ী কোনো আবাস গড়তে জানেনি, সেই সময়ে মায়ানরা কী করে ২৫-৩০ তলার সমান উঁচু স্থাপনা তৈরি করেছিল? জ্যোতির্বিদ্যা আর ভাষা নিয়ে রেখেছিল অগাধ জ্ঞান? কেমন করে তারা সবার চাইতে উন্নত হয়ে গিয়েছিল?

যাই হোক, সে অন্য আলাপ। পরাক্রমশালী এক জাতি হওয়ার পাশাপাশি তাদের ছিল অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুন। সেগুলোই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।


পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন



প্রথমেই আসা যাক মায়ান ভাষার দিকে। মায়ানদের তৈরি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা গেছে যে, ভাবের আদান-প্রদানের জন্যে তারা একটি ভাষার ব্যবহার অবশ্যই করত। সেই ভাষার লিখিত রূপটি বেশ মজার। কোনো বর্ণমালা তাদের ছিল না, লেখার জন্যে ব্যবহার করত ছবি বা চিহ্ন। যাকে বলা হয় গ্লাইফস। প্রায় ৮০০টির বেশি ছবি তারা ব্যবহার করেছিল তাদের লেখায়। এসব লেখা থেকে তাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া তারা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজ দিয়ে বই বানাতো, সেগুলোকে বলা হয়ে থাকে কোডেক্স। মায়ান সভ্যতার মাত্র ৪টি কোডেক্স উদ্ধার করা হয়েছে অক্ষতভাবে। মায়ানরা লেখার কাজ চালাত তুলি দিয়ে, কলম তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এই তুলিগুলো তারা বানাতো পশুর লোম অথবা লেজের সাহায্যে।

এবারে যাওয়া যাক মায়ান ক্যালেন্ডারের দিকে। মায়ানরা নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল, তা-ও আবার খ্রিস্টপূর্ব সময়েই! ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকেই মায়ানদের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করে নিয়েছিল তারা। মায়ানরা সুচারুভাবে দিন তারিখের হিসাব লিপিবদ্ধ করত। তাদের ক্যালেন্ডার ছিল আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তাদের ক্যালেন্ডারে অক্ষর এবং সংখ্যার পরিবর্তে ছিল হায়ারোগ্লিফিক চিত্রের সমাহার। ক্যালেন্ডারগুলোতে তারিখগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হতো। বোঝার সুবিধার জন্য বৃত্তাকার চাকার উপরে ক্যালেন্ডারের দিন এবং বার বা মাসগুলোর চিত্র অঙ্কন করে, সেই চাকাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিন তারিখের হিসেব বের করা হতো।

মায়ানদের মোট তিনটি ক্যালেন্ডার ছিল। একটি হলো পবিত্র ক্যালেন্ডার বা ধর্মীয় ক্যালেন্ডার। এটি জোলকিন নামে পরিচিত। ২৬০ দিন বিশিষ্ট এই ক্যালেন্ডার বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসের হিসেব রাখা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয়টি নাগরিক ক্যালেন্ডার বা কৃষি ক্যালেন্ডার। ধর্মনিরপেক্ষ এই ক্যালেন্ডার হাব নামে পরিচিত। এটি আমাদের প্রচলিত ক্যালেন্ডারের মতো ৩৬৫ দিন বিশিষ্ট, যদিও এতে লিপ ইয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই ক্যালেন্ডারটি ব্যবহৃত হতো কৃষিকাজসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য। তৃতীয় ক্যালেন্ডারটিকে বলা হয় দ্য লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার। এটি ব্যবহার করা হতো ঐতিহাসিক ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করার কাজে। এর মাধ্যমে অতীতে বা ভবিষ্যতে হাজার হাজার বছর পর্যন্ত হিসেব রাখা যেত।

এবারে আসা যাক মায়ান মুখোশের দিকে। মায়ানরা বিভিন্ন উৎসবে মুখোশ পরত। মুখোশ আবিষ্কারের ধারণা তাদের নিজেদের। নিজেদের প্রয়োজনেই তারা মুখোশ তৈরি করেছিল। মুখোশগুলো তৈরি হত জেড, স্বর্ণ, পালক এবং বিভিন্ন ধাতু দিয়ে। মায়ানরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অথবা কারো মুত্যুর দিনে মুখোশ পরত বেশি। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, মায়ানরা বিশ্বাস করত পাতাল থেকে দৈত্য এসে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারে। এসব দৈত্যদের ভয় দেখাতে মায়ানরা বিভিন্ন মুখোশ পরত। তাদের মুখোশগুলো ছিলো মূলত দৈত্যদের ভয়ের প্রতীক। মায়ান পুরাকথার জনপ্রিয় প্রাণী, যেমন- জাগুয়ার এবং সাপের মুখোশ মায়ানরা ব্যবহার করত। মৃতদেহ পোড়ানোর সময় এসব মুখোশ তারা মৃতদেহের পাশে রাখত। তবে মায়ানরা যেসব মুখোশ পরত, তার বেশিরভাগই ছিল কোনো না কোনো ঈশ্বরের প্রতীক। মায়ান শ্যামানরা সাধারণত চার ধরনের মুখোশ পরতো। বাকিরা পড়তো আট ধরনের মুখোশ।

মায়ান সভ্যতার আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল দ্য স্যাক্রেড বল গেইম। মায়ান এই বল গেইম নিছক কোন খেলা ছিল না, এর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। মাঝে মাঝে জয়ী দলকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। ক্যান ইউ বিলিভ দ্যাট? মায়ানরা বিশ্বাস করতো এই খেলা অন্ধকার ও আলোর শক্তির মধ্যকার চিরন্তন সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে। পাশাপাশি পরাজিত দলের অধিনায়ককে রিচুয়ালিস্টিক বলিদানের মুখোমুখি হতে হতো। দেবতাদের খুশি করা এবং জাতিগত উর্বরতা ও সমৃদ্ধির আশায়।

আপনারা কি জানেন যে মায়ানদের একটি নির্দিষ্ট পানীয়ের প্রতি গভীর মুগ্ধতা ছিল যা আমরা সবাই পছন্দ করি? সেটা কি জানেন? চকলেট! মায়ানরা মূলত ক্যাকাওকে দেবতাদের পানীয় মনে করত। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান এবং এমনকি মুদ্রা হিসাবে এটি গ্রহণ করত। এটি এমন মূল্যবান ছিল যে এর ব্যবহার এবং বাণিজ্যের উপরে কঠোর নিয়মাবলী ছিল।

এবারে যাওয়া যাক মায়ান সভ্যতার আরেকটু অন্ধকার দিকে। মায়ানরা বিশ্বাস করত মানুষের রক্ত দেবতাদের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী নৈবেদ্য। তারা ঐশ্বরিক যোগাযোগ স্থাপন করার এবং বৈশ্বিক ভারসাম্য বজায় রাখার উপায় হিসাবে রক্তপাতের রিচুয়াল শুরু করেছিল। এটি একটি জটিল এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল যেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশে পিয়ার্সিং করা হতো। রহস্যময় মায়া সভ্যতার বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে ও আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে আমরা আজ কথা বললাম। স্যাক্রিফিসিয়াল বল গেইম থেকে শুরু করে চকলেটের ডিভাইন পাওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলাই যায়, মায়ান সভ্যতার ছিল উদ্ভট কিন্তু সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও রীতিনীতি।

মতামত

0Comments

আপনার মতামত লিখুন (0)

#buttons=(ঠিক আছে!) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটি ব্যবহারে আপনার অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য কুকিজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমরা কখনই আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার কোনো ডাটা সংরক্ষণ করব না। আরো জানুন
Ok, Go it!