অনিন্দ্যসুন্দর এবং বিশালাকৃতির স্থাপত্যশৈলীর নমুনা দেখতে পাওয়া যায় পেরুর ইনকা সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শনে। আর এর মাঝে সবচাইতে পরিচিত বোধহয় মাচু পিচু। চারপাশে আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়, নিচে খরস্রোতা উরুবামবা নদী, আর শিল্পীর আঁকা পটের ছবির মতো মেঘে ঘেরা মাচু পিচু। এটি একটি ইনকা পিরামিড আকৃতির শহর, যা আকার আকৃতি এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনেকগুনে হার মানায় মিশরীয় পিরামিডকেও। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই ৪৩০ মিটার ওপরে মাচু পিচু দাঁড়িয়ে আছে একটি বিষুবীয় পাহাড়ি বনের মাঝে। এর চারপাশের পাথুরে দেয়াল, ছাদ এবং নকশা দেখে মনে হতে পারে এটি আলাদাভাবে তৈরি করা হয়নি বরং উঠে এসেছে গাছগাছালির মাঝে থেকেই। আন্দেজ পর্বতমালার পূর্ব পাশের ঢালে অবস্থিত এই এলাকাটি ঢেকে থাকে নীল মেঘের আড়ালে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
স্থানীয় কোয়েঞ্চা ভাষায় মাচু পিচু এর অর্থ হল বুড়ো পর্বত। ইনকাদের “হারানো শহর” বলেও একে ডাকা হয় মাঝে মাঝে। বসবাসের এলাকা এবং কৃষি এলাকায় বিভক্ত পুরো স্থাপনাটি দখল করে আছে প্রায় ৩২ হাজার ৫০০ হেক্টর এলাকা। এছাড়াও শহরের মাঝে রয়েছে উঁচু নিচু বিভাজন। শহরের উঁচু অংশে রয়েছে মন্দিরগুলো, নিচু অংশে রয়েছে গুদামঘর। এর স্থাপত্যশৈলীর মাঝে প্রকৃতির ছাপ পাওয়া যায়। বর্গাকৃতির পাথর কেটে জোড়া লাগিয়ে তা দিয়ে স্থাপনা তৈরির কাজে দক্ষ ছিল ইনকা মানুষেরা। এই পাথরের মধ্যবর্তী জোড়া এতই শক্ত যে এখনও পর্যন্ত ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে তাতে ফাঁক খুঁজে বের করা যায় না।
মাচু পিচুর প্রশস্ত বর্গাকৃতির
কেন্দ্রে একই সমতলে অবস্থিত প্রায় ২০০টি ভবন। এতে আরও রয়েছে বিভিন্ন ‘কাঞ্চা’
যেগুলো আসলে কতগুলো ভবনের সমস্তি এবং এগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের ঢালের সাথে
সামঞ্জস্য রেখে। কৃষিকার্যের সুবিধার্থে সেখানে ছিল জটিল সেচ ব্যবস্থা। এই
স্থাপনার বিভিন্ন উচ্চতায় ওঠার জন্য রয়েছে অগণিত সিঁড়ি। স্থাপনার পশ্চিম অংশটি
সম্ভবত উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হত। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত ‘টোরিয়ন’, বিশালাকৃতির একটি টাওয়ার যা সম্ভবত ব্যবহৃত হত মানমন্দির হিসেবে। আরও
রয়েছে ইনকা সভ্যতার তিন অমূল্য রত্ন-‘ইন্তিহুয়াতানা’, ‘সূর্যমন্দির’
এবং ‘তিন জানালার কক্ষ’।
এর তিনটিই হলো তাদের সূর্য দেবতা ‘ইন্তি’ এর উপাসনার নিমিত্তে তৈরি। এছাড়াও ছিল নিম্নবর্ণের মানুষের বসবাসের এলাকা যাতে ছিল সাধারণ ধাঁচের কিছু বাসাবাড়ি এবং গুদাম। উচ্চবর্ণের, অভিজাত মানুষের বসবাসের এলাকা ছিল আলাদা, একটি ঢালের ওপর সাজানো। ‘আমাউতাস’ বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের বাড়ি ছিল লাল দেয়ালের। আবার ‘নুস্তাস’ বা রাজকন্যাদের ঘরগুলো ছিল ট্রাপিজিয়াম আকৃতির। এখানে আরও রয়েছে অলঙ্কৃত স্মারক সমাধিস্তম্ভ যা মূলত বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত। অতীতে এই এলাকা থেকে ঐতিহাসিক নিদর্শন চুরি, পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় ইত্যাদি কারণে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং তা ঠেকানোর জন্য নেওয়া হয় বিভিন্ন ব্যবস্থা। এর বিধ্বস্তপ্রায় ভবনগুলোকে সংস্কার করারও প্রক্রিয়া চলছে অনেকদিন থেকেই।
ইনকাদের সম্পর্কে একটি বিষয় এত দিন খুবই বিস্ময়ের ছিল। ইনকারা লিখতে জানতেন না। নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় তাঁরা কথা বলতেন তা হরফে প্রকাশ করতে পারতেন না। সম্প্রতি ইনকাদের সম্পর্কে এই ধারণাটিই বদলে গিয়েছে। এক কলেজ ছাত্র তাঁর শিক্ষকের সাহায্যে ইনকাদের ভাষা কিংবা তথ্য প্রকাশের অদ্ভুত মাধ্যমের খোঁজ পেয়েছেন। নিজেদের যাবতীয় তথ্য তাঁরা নাকি হরফে না লিখে সুতোয় গিঁট বেঁধে প্রকাশ করতেন! কী রঙের সুতো, কতগুলি গিঁট দিচ্ছেন, দু’টি গিঁটের মধ্যে দূরত্ব কতটা— এ সব দেখেই তাঁরা বুঝে যেতেন কী তথ্য রয়েছে তাতে। ইনকা সভ্যতা থেকে এ রকম গিঁট বাঁধা দড়়ি কিংবা সুতোর খোঁজ আগেও পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এত দিন তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা গোপন তথ্য বুঝে উঠতে পারেননি কেউ। তাঁদের সমস্ত তথ্যের রেকর্ড রয়েছে গিঁট বাঁধা ওই রঙিন সুতোর মধ্যেই। যেগুলিকে ‘খিপু’ বলা হত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া ম্যানি মিড্রানো তাঁর শিক্ষক গ্যারির সাহায্যে এই রহস্যের সমাধান করে ফেলেছেন। ইউনেস্কোর ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ইন ডেঞ্জার-গুলোর মাঝে একটি হল মাচু পিচু। ১৯১১ সালে আবিষ্কৃত হবার পর এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েই চলছে! এছাড়া কিছুদিন পেরুর প্রশাসন এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির মাঝে দ্বন্দ্ব ছিল এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অধিকার নিয়ে।
জুলাই-অগাস্ট মাসে পর্যটকদের
আনাগোনায় সবচাইতে ব্যস্ত থাকে মাচু পিচু। এই সময়টাতে বেড়াতে গেলে আপনি মানুষের
ভিড়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না আর তাছাড়া বৃষ্টি-বাদলায় যে কোনও সময়ে
আটকা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টি এড়িয়ে মাচু পিচুতে বেড়াবার সবচাইতে ভালো
সময় হল নভেম্বর এবং এপ্রিল। মাচু পিচুতে বেড়াবার জন্য পায়ে হাঁটার কোনও বিকল্প
নেই। ইনকারা পায়ে হেঁটে যে পথে মাচু পিচুতে উঠত, সেই পথ এখনও
হাঁটার উপযুক্ত এবং মাচু পিচুর সৌন্দর্য এভাবেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা সম্ভব।