১৬৪২ সালের ১৪ আগস্ট। ডাচ নাবিক আবেল তাসমান বের হন এক কিংবদন্তিতুল্য সমুদ্রযাত্রায়। ব্যবসায়িক কাজে তারা কয়েক সপ্তাহ মরিশাসে থেকে সেখান থেকে রওনা দেন সলোমন দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঝড়ো আবোহাওয়ার কারণে তিনি কিছুটা উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঝড় যখন শেষ, তখন তিনি আবিষ্কার করেন এক অজানা দ্বীপে চলে এসেছেন। সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা ছিল ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে একটি বড় মহাদেশ আছে। যার নাম তারা দিয়েছিল টেরা অস্ট্রেলিস ইনকগনিটা। তিনি ভেবেছিলেন সেটিই হয়তো পেয়ে গেছেন তিনি। আসলেই কি পেয়েছিলেন?
না, সেই মহাদেশ খুঁজে পান নি তিনি। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বর্তমান সময়ের তাসমানিয়া দ্বীপ। যা মূলত তার নাম থেকেই এসেছে। এরপরে তিনি আশেপাশে আরো খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে নিউজিল্যান্ডও আবিষ্কার করেন তিনি। কিন্তু সম্পূর্ণ কোন মহাদেশ খুঁজে পান নি। সেই ঘটনার প্রায় ১০০ বছর পরে ১৭৬৯ সালে জেমস কুক বের হন প্রশান্ত মহাসাগর এক্সপ্লোর করতে। তার উদ্দেশ্য ছিল টেরা অস্ট্রেলিস ইনকগনিটা মহাদেশ খুঁজে বের করা। কিন্তু ৬ মাস ধরে খুঁজেও কিছুই না পাওয়ায় তিনি ধরে নেন এর অস্তিত্বই আসলে নেই।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
কিন্তু তার এই ধারণা ছিল ভুল। সায়েন্টিস্ট নিক মর্টিমার ও
হামিশ ক্যাম্পবেল তাদের লেখা ‘জিল্যান্ডিয়াঃ আওয়ার কন্টিনেন্ট রিভিলড’ বইতে লেখেন,
জেমস কুক সেই অভিযানে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ জিল্যান্ডিয়া ছিলে তার জাহাজের নীচেই।
অর্থাৎ সমুদ্রের নীচে। তার ধারণাই ছিল না যে এরকম কিছু থাকতে পারে।
পরের ঘটনা ১৮৯৫ সালের। নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে বিভিন্ন দ্বীপ নিয়ে রিসার্চ করছিলেন স্কটিশ প্রকৃতিবিদ স্যার জেমস হেক্টর। তখনই প্রথমবারের মতো টেরা অস্ট্রেলিস ইনকগনিটা অর্থাৎ জিল্যান্ডিয়া মহাদেশের অস্তিত্ব টের পান তিনি। তার মতে সেটি ছিল সমুদ্রের নীচে ডুবে থাকা একটি মহাদেশের চূড়া। প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগের একটি প্রাচীন সুপারকন্টিনেন্টের অংশবিশেষ ছিল এটি। পানির নিচে ডুবে থাকা মহাদেশ জিল্যান্ডিয়াকেই অনেকে দাবি করে থাকেন পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ হিসেবে। খনিজ সম্পদে ভরপুর এই জিল্যান্ডিয়া পরিচিত নিউজিল্যান্ড মহাদেশ বা তাসমান্টিস নামেও। নিউজিল্যান্ড এই মহাদেশের পানির উপরে থাকা একমাত্র অংশ। বাকি সবটুকুই পানির নিচে। এই কারণেই বিজ্ঞানীরা মহাদেশটির নাম দিয়েছেন জিল্যান্ডিয়া। আয়তনের দিক দিয়ে এটি প্রায় ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। আকারের দিক দিয়ে প্রায় ভারতীয় উপমহাদেশের সমান। জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের মতে, জিল্যান্ডিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে আলাদা হয়েছিল অ্যান্টার্কটিকা থেকে। অন্যদিকে ৬-৮ কোটি বছর আগে জিল্যান্ডিয়া আলাদা হয় অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে। এরপর যত সময় গড়িয়েছে ততই সমুদ্রের গভীরে হারিয়েছে জিল্যান্ডিয়া। ধারণা করা হয়, ২.৩ কোটি বছর আগে সম্পূর্ণ মহাদেশটিই ছিল সমুদ্রের নীচে। পরবর্তীতে প্লেট মুভমেন্ট-এর কারণে পানির উপরে উঠে আসে নিউজিল্যান্ড।
বর্তমানে এটি সাগরের প্রায় ৩ হাজার ৮০০ ফুট গভীরে ডুবে আছে। এর প্রায় ৯৩ থেকে ৯৪ পার্সেন্টেজ প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে। এই অঞ্চলের উপকূল জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য প্রায় কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সমুদ্রের নীচে থাকায় জিল্যান্ডিয়ার ব্যাপারে প্রায় সবকিছুই এখনো আমাদের অজানা। প্রপার রিসার্চ করারও সুযোগ নেই। হুট করে এত বড় একটি মহাদেশ সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গেলো কেন? পানির উপরে থাকাকালীন সেখানে কোন কোন প্রাণী বাস করতো? – এসব প্রশ্ন এখন শুধুই রহস্য। যার উত্তর নেই জিওলজিস্টদের কাছে। নিউজিল্যান্ড যেমন জেগে উঠেছে, হয়তো জিল্যান্ডিয়ার বাকি অংশও ভবিষ্যতে কখনো জেগে উঠতে পারে। সেই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ কিন্তু নেই!

