“মোনালিসা”। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির এক অনবদ্য সৃষ্টি। এটা শুধু একটা আঁকা ছবি নয়, যেন এক অজানা রহস্যের হাতছানি। তার চোখের তির্যক চাহনি, চাপা হাসি আর রহস্যে ভরা মুখ একঝলক দেখার আশায় ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে প্রতিদিন ভিড় জমে যায়। কি এমন রহস্য?
শুনলে অবাক হবেন, মোনা লিসার ওই বিখ্যাত ছবির ক্যানভাস জুড়ে আছে অজস্র গোপন কোড। যেন ছবি আঁকার ছলে একের পর এক সংকেতের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন ভিঞ্চি। সে এমনই চ্যালেঞ্জ যার গোলকধাঁধায় আজও হাবুডুবু খায় বিশ্বের তাবড় সব চ্যালেঞ্জাররা। আলট্রা ভায়োলেট পদ্ধতি ব্যবহার করে মোনা লিসার ছবিটিকে স্ক্যান করার সময় ক্যানভাসের বাঁদিক থেকে ভিঞ্চির লেখা একটি বার্তা উদ্ধার করা হয়। সেখানে লেখা ছিল “লা রিস্পোসতা শি ট্রোভা কুই”। ইতালীয় ভাষায় লেখা যার অর্থ - ‘উত্তর এখানেই আছে’। কিন্তু কীসের উত্তর? পাইন কাঠের টুকরোর উপর ১৬ শতকে আঁকা এই পেইন্টিং-এ কোন প্রশ্নের উত্তর জানানোর চেষ্টা করেছিলেন ভিঞ্চি? সে রহস্যের সমাধান হয়নি আজও।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
১৫০৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ ৪ বছর ধরে এই রহস্যময় ছবিটি এঁকেছিলেন দা ভিঞ্চি। ১৭৫৭ সালে এই পেইন্টিং ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মোনা লিসা কীভাবে সেখানে এল সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে না। ইতালিয়ান ভাষায় “মোনা লিসা” কথাটির অর্থ হলো ‘একটু আগে বলা হলো’।
অনেক গবেষক মনে করেন এই পেইন্টিং আসলে লিওনার্দোর নিজেরই প্রতিকৃতি, অর্থাৎ এই ছবিতে তিনি নিজেকে এক নারী রূপে কল্পনা করেছেন। ভিঞ্চি ও মোনালিসার ছবি পাশাপাশি রেখে তাঁরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন স্রষ্টা আর সৃষ্টির অবয়বের আশ্চর্য মিল। দুজনেরই চোখ, ঠোঁট, মুখ, চোয়ালের গঠন অনেকটা একই রকম।
আবার কারও কারও মতে মোনা লিসা আসলে মাদার মেরির কল্পিত পেইন্টিং। কেউ কেউ এটাও বলেন যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই ছবিতে নিজের মাকে এঁকেছেন। শিল্পের পৃথিবীতে এ যেন এক চিরন্তন তর্ক। আসলে মোনা লিসা কে? কবির কল্পনা, না বাস্তবে সে সত্যিই ছিল!
২০০৪ সালে বিজ্ঞানী প্যাসকেল স্কটে মোনালিসার পেইন্টিংকে নানানভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন, এই ছবি আঁকতে যে রঙের ব্যবহার করা হয়েছিল তার ঘনত্ব মাত্র ৪০ মাইক্রোমিটার অর্থাৎ একটি চুলের থেকেও সূক্ষ্ম সে রং। আশ্চর্যের ব্যাপার, এত পাতলা রঙের ব্যবহার করার পরেও পাঁচশো বছর ধরে এ ছবি কীভাবে টিকে আছে তা জানা নেই। এমনকি আজকের গবেষকেরা এমন দাবিও করেন মূল মোনা লিসা ছবির নীচে আরও তিনটি ছবির ড্রাফট লুকিয়ে আছে। কেন অন্য ছবির উপর মোনালিসা আঁকলেন দ্য ভিঞ্চি? রহস্য এখানেও।
১৫১৯ সালে দা ভিঞ্চির মৃত্যুর পর থেকেই ছবিটা ফ্রান্সের রাজাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অংশ হয়ে গেছিল। যুগ যুগ ধরে মোনালিসা তার হাসি দিয়ে উন্মাদ করে গেছে অনেককেই। ২৩ শে জুন ১৮৫২ সালে লুই মাসফেরো নামে এক ফরাসি তরুণ শিল্পী প্যারিসে এক বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে নিজের সুইসাইড নোটে তিনি লিখে রেখে গেছিলেন এক আশ্চর্য কথা। লিখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ি মোনালিসার হাসি।
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, মোনা লিসার হাসি বড় রহস্যমেদুর। কেউ বলেন তা বিষাদের হাসি, কেউ বলেন আনন্দের। আবার আপনি যদি সরাসরি মোনালিসার ঠোঁটের দিকে তাকান, তাহলে কিন্তু মনে হবে না সে ঠোঁটে হাসির চিহ্নমাত্র আছে। কিন্তু যদি ফোকাস তার ঠোঁট থেকে সরিয়ে সামগ্রিক মুখে, বা মুখের অন্য যে কোনো অংশে করা হয় তাহলে মনে হবে তার ঠোঁট হাসছে। ২০০০ সালে বিজ্ঞানী ডক্টর মার্গারেট এ বিষয়ে একটি জার্নাল লেখেন। তাঁর মতে মোনালিসার হাসি বদলায় না, বদলায় আসলে মানুষের মাইন্ডসেট। অর্থাৎ আপনি তাকে যেভাবে দেখতে চান ঠিক সেভাবেই আপনার কাছে ধরা দেয় মোনা লিসা। তাহলে দা ভিঞ্চির কাছে কীভাবে ধরা দিয়েছিল সে? কোন ইশারায় এমন রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুললেন শিল্পী? জানলে অবাক হবেন, মোনা লিসাকে গড়ে তোলার বছরগুলোতে দা ভিঞ্চি রাত কাটাতেন তার স্টুডিওর কাছে এক হাসপাতালে। যেখানে তিনি মানুষের ত্বক, পেশী ও স্নায়ু নিয়ে গবেষণা করতেন। এর প্রভাব পড়েছে মোনালিসার হাসির ওপর। হাসির সময় পেশীর নিয়ন্ত্রণ, নড়াচড়ার সূক্ষ্ম রসায়ন এই ছবির অবয়বে ফুটে উঠেছে বলে গবেষকরা মনে করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘দ্যা প্যারানর্মাল ক্রুকিবল’ নামে একটি ওয়েবসাইট দাবি করে মোনালিসা পেইন্টিং-এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক এলিয়েন। এ কথা কতটুকু সত্য সেটা যাচাই করার আগে বলি, আয়নার সাথে নাইন্টি ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে যদি মোনালিসার প্রিন্টিং করা হয়, তাহলে বাস্তব ছবি আর আয়নায় প্রতিফলিত ছবি, এই দুইয়ের মাঝে মাঝে একটা আশ্চর্য ইমেজ তৈরি করে যার আকৃতি অনেকটা মহাবিশ্বের অজানা প্রাণী বা এলিয়েনের মত। তার থেকেও আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই আকৃতিটা ঠিক সেই জায়গায় তৈরি হয় যেখানে দা ভিঞ্চি লিখে রেখে গেছেন “উত্তর এখানেই আছে”।
প্রাচীন কোনও নক্ষত্র থেকে কি তবে এসেছিল কোনও গুপ্ত সংকেত! অন্য গ্রহের কোনও প্রাণীর উপস্থিতি কি তবে টের পেয়েছিলেন জ্যোতির্বিদ গবেষক দা ভিঞ্চি! মেলেনি কোনো উত্তর। তাই মোনালিসার রহস্যময় হাসি আজও মুগ্ধ করেই রেখেছে তার মায়ার জালে।