কিভাবে ধর্মে পরিণত হলো কালোজাদু ভুডু || Africa's Most Mysterious Religion: Voodoo

Author
0


ভুডু শব্দটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় কি আসে? ব্ল্যাক ম্যাজিক, রাইট? সুতা পেঁচানো একটি পুতুলের উপরে অনেকগুলো সুই গাঁথা। সব মিলিয়ে ভয়ানক ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু ভুডু নামে যে একটি আস্ত ধর্মই রয়েছে, তা কি জানেন?


কি এই ভুডু?

ব্ল্যাক ম্যাজিক ও ডাইনিবিদ্যা নিয়ে মানুষের যেমন রয়েছে ভয়, তেমনি রয়েছে প্রবল আগ্রহও। আমরা সিনেমাপ্রেমীরা ডাব্বে, সিচ্চিনসহ বিভিন্ন বিখ্যাত হরর সিনেমায় গা ছমছমে সব ভুডুবিদ্যার দৃশ্য দেখে এসেছি। মূলত কারো আত্মাকে বশে আনার জন্য করা হত ভুডুবিদ্যার প্রয়োগ। এটি খুবই পুরাতন একটি চর্চা।


পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন



ভুডু ধর্মটিও খুবই প্রাচীনএই ধর্মে ব্ল্যাক ম্যাজিক ও উইচক্রাফটের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। পৃথিবী বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ায় সময়ের স্রোতে এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা কমে গেছে অনেকটাই। তবে এখনো আফ্রিকায় এর প্রচুর অনুসারী আছে। স্পেশালি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনে। এমনকি প্রতি বছরের ১০ জানুয়ারী তারা ভুডু উৎসব পালন করে। এই দিনে সরকারী ছুটিও ঘোষণা করেছে সরকার।

তবে ইউরোপ কিংবা অ্যামেরিকান কালচারে ব্ল্যাক ম্যাজিককে যতটা ভয়ংকর রূপে দেখানো হয়, তার সাথে সত্যিকারের ভুডুর অনেক পার্থক্য রয়েছে। ভুডু ধর্মের অনুসারীরা খারাপ আত্মা নয়, বরং ভালো আত্মার প্রার্থনা করে। শুধু যে ওয়েস্টার্ন কালচারেই তাদের নিয়ে এমন ভ্রান্ত ধারণা তা নয়, খোদ আফ্রিকাতেও তা রয়েছে। বড় কোন দুর্যোগ ঘটলেই তারা মনে করে সেটি ভুডুয়ানদের ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রভাবে হয়েছে।


ভুডু ধর্মের বেসিক

এবারে ভুডু ধর্মের একটু গভীরে ঢোকা যাক। এই ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো - এটি একইসাথে সর্বেশ্বর এবং একেশ্বরবাদী। তাই ভুডুয়ানরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একজন প্রাইম গডে আস্থা রাখে। সেই প্রাইম গডের নাম বনডাই।

অনেকটা হিন্দু ধর্মের মতোই বিভিন্ন জগতকে কেন্দ্র করে তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবী রয়েছেভুডুয়ানদের মোট দেবতার সংখ্যা প্রায় ১০০ টি, যাদেরকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘মাহু’দেবতাদের নামগুলোও ভারী অদ্ভুত। যুদ্ধবাজদের দেবতার নাম ‘গৌ’, রোগব্যাধি-আরোগ্য ও মাটির দেবতার নাম ‘সাকপাতা’, ঝড়-বজ্রপাত ও ন্যায়বিচারের দেবতার নাম ‘হেভিয়রসো’ আর পানির দেবতার নাম ‘মামি ওয়াটা’

ভুডু ধর্মের প্রধান ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে চারটি প্রাকৃতিক দর্শনের উপরে – জীবন, আত্মা, সংগীত ও নাচ। আধুনিক দুনিয়ায় জাদু বলতে আমরা সাধারণত ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করাকেই বুঝি। তবে ভুডুয়ান প্রিস্ট কিংবা ওঝারা মূলত মানুষকে খারাপ শক্তি থেকে রক্ষা করে থাকে। এছাড়াও তারা মানুষকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং প্রাকৃতিক ও ভেষজ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অনেকটা অ্যামাজনের শামানদের মতো।

ভুডুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তারা দুটি ভিন্ন জগতে বিশ্বাস করে। একটি আমাদের এই জগত, অপরটি অদেখা জগৎ। আর মৃত্যু হলো এই দুই জগতের যোগসূত্র। তারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ এই দ্বিতীয় জগতে প্রবেশ করে। এবং জীবিতদের সাথে মৃতরাও আমাদের মাঝেই বসবাস করে

মৃত ব্যক্তির আত্মাকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘লোয়া’লোয়া কয়েক রকমের হতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিভিন্ন প্রয়োজনে ওঝারা বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মার শরণাপন্ন হন। সমাজে সমান অধিকারের শিক্ষা দিতে চাইলে তারা মহাত্মা গান্ধীর আত্মাকে আমন্ত্রণ জানান। অদ্ভুত না?



ভুডু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান

ভুডু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলোও বেশ অদ্ভুত এবং মজার। তার মধ্যে সবথেকে ইন্টারেস্টিং হলো ‘গুনগুন’প্রতিবছর একটি বিশেষ দিনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গুনগুনরা রঙবেরঙের অদ্ভুত আলখাল্লা পড়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়তারা বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেয়। ভুডুয়ানদের বিশ্বাস, এদিন গ্রামবাসীদের পূর্বপুরুষদের আত্মা এসে গুনগুনের উপর ভর করে।

এই গুনগুনরা মূলত বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের বিভিন্ন ঝামেলা সমাধান করতে সাহায্য করে এবং পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেগুনগুনের দেয়া সেই সিদ্ধান্তকেই মাথা পেতে নেওয়া হয়। তবে সাধারণ মানুষরা গুনগুনের ধারেকাছে ঘেষে না তাদের মতে, গুনগুন যদি কাউকে স্পর্শ করে, তবে সেই ব্যক্তি ও গুনগুন দুজনই সাথে সাথে মারা যাবে

ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের আশায় পৃথিবীর বহু ধর্মেই বলি দেওয়ার নিয়ম আছে। তেমনি ভুডু ধর্মেও পশু বলি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারএছাড়াও ভুডুয়ানরা বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তির পূজাও করে থাকেযেমন বানর, কুকুর, সাপ ও কুমির।


বর্তমানে তারা যেসব ক্রাইসিস ফেইস করছে

ধর্মে ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে ভুডু ধর্ম অনেক রঙিন মনে হলেও বর্তমানে তাদের চলছে সংকটপূর্ণ সময়। এখানে বলে রাখা দরকার, ধর্ম হিসেবে ভুডু কেবল বেনিন কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি টোগো, নাইজেরিয়ারও অন্যতম প্রধান ধর্ম। এছাড়াও মধ্য আমেরিকার দেশ হাইতি, কিউবা কিংবা নিউ অরলিয়েন্স এবং লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলেও ব্যাপকভাবে ভুডুর চর্চা রয়েছে। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ধর্ম ভুডু।

আফ্রিকান ভুডুধর্মীদের থেকেও সংকটটা বেশি মধ্য আমেরিকান ভুডুধর্মীদের। আফ্রিকা যখন মার্কিন উপনিবেশে ছিল, তখন সেখান থেকে প্রচুর দাস-দাসীকে মধ্য আমেরিকার দ্বীপগুলোতে নিয়ে আসা হয়েছিলযাদের বেশিরভাগকেই পরবর্তীতে জোর করে খ্রিস্টধর্মে কনভার্ট করা হয়। তবে হাইতির মানুষের বিশ্বাস সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, "৭০% ক্যাথলিক, ৩০% প্রোটেস্ট্যান্ট, কিন্তু ১০০% ভুডু"। রিসেন্টলি হাইতি এবং মধ্য আমেরিকার অনেক দেশেই ভুডু যাজকরা খ্রিষ্টানদের হাতে নিহত হয়েছে

মতামত

0Comments

আপনার মতামত লিখুন (0)

#buttons=(ঠিক আছে!) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটি ব্যবহারে আপনার অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য কুকিজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমরা কখনই আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার কোনো ডাটা সংরক্ষণ করব না। আরো জানুন
Ok, Go it!