রহস্যে ঘেরা এক বাড়ি “উইনচেস্টার মিস্টি হাউস” - Winchester Mystery House

Author
0

ভিক্টোরিয়ান মডেলের একটা প্রাসাদ বাড়ি বানাতে কতো সময় লাগতে পারে? ৩ বছর? ৫ বছর? ১০ বছর?

ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসেতে একটি বাড়ি। নাম "উইনচেস্টার হাউজ"। যার নির্মাণ কাজ চলেছিলো দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে। কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ কিংবা কোনো শ্রমিক আন্দোলনের কবলেও পড়েনি এই বাড়ির নির্মাণ কাজ। কিভাবে নির্মিত হলো এই বাড়িটি?


পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন



ওয়েস্টার্ন উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রে প্রায়ই উইনচেস্টার রাইফেলের নাম পাওয়া যায়। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে অষ্টাদশ দশকের শেষের দিকে এর ডাকনাম দেয়া হয় ‘দ্যা গান দ্যাট ওন দ্যা ওয়েস্ট’। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ সহ আরো বিভিন্ন যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখা এই রাইফেল এখনো পর্যন্ত ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর মধ্যে একটা বলে ধরা হয়। উইনচেস্টার রিপিটিং আর্মসের জনক অলিভার উইনচেস্টারের ছেলে ছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ট উইনচেস্টার, যিনি পারিবারিকভাবেই পরিণত হয়েছিলেন আরেক বিশাল ধনী অস্ত্র ব্যবসায়ীতে। উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী সারাহ উইনচেস্টারের মাত্র ৬ সপ্তাহ বয়সী শিশুকন্যা অ্যানি “মারাসমোস” নামক এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৬৬ সালে মৃত্যুবরণ করে। তার ১৫ বছর পরে উইলিয়াম নিজেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে তার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। উইলিয়াম ওয়ার্ট উইনচেস্টার মারা যাবার পরে, সারাহ উইনচেস্টার উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হন ২০.৫ মিলিয়ন ডলারের, যা কিনা বর্তমানে ৫২০ মিলিয়ন ডলারের সমকক্ষ। এত প্রাচুর্য সারাহকে স্পর্শ করেনি, তিনি সারা জীবনই স্বামী-সন্তানের জন্য শোক পালন করে গেছেন। ইউরোপ থেকে স্পিরিচুয়ালিজমের প্রচলন ভালোভাবেই ছড়িয়েছিল গৃহযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকায়। লোকমুখে শোনা যায়, বোস্টন থেকে আসা এক মিডিয়ামের মাধ্যমে সারাহ তার মৃত স্বামীর আত্মার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তারপর থেকেই তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, ‘উইনচেস্টার রাইফেল’ এর গুলিতে নিহত মানুষের অতৃপ্ত আত্মারা তাদের সকল বৈষয়িক সম্পত্তিকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। সেই মিডিয়াম নাকি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলো পশ্চিম থেকে দূরে কোথাও গিয়ে ক্রমাগত বাড়ি নির্মাণ করতে থাকলেই কেবল এই অভিশাপ থেকে বাঁচা যাবে।



১৮৮৪ বা ৮৫ সালের দিকে কানেক্টিকাট থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে ‘সান্তা ক্লারা ভ্যালি’র মাত্র আট কক্ষবিশিষ্ট একটি অসমাপ্ত ফার্মহাউজ কিনে সারাহ উইনচেস্টার তার প্রাসাদ বানানো শুরু করেন। সব মিলিয়ে এই বাড়ির পেছনে তিনি খরচ করেন প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে ৭০ মিলিয়ন ডলারের মতো। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে বানানো এই প্রাসাদ বাড়ির পেছনে ২০,০০০ গ্যালনেরও বেশি রঙ ব্যবহৃত হয়েছিলো। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও বাড়ির আর্কিটেকচার ডিজাইনটিও সারাহর নিজেরই করা।

সারাহ “১৩” সংখ্যাটিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। তার দলিল ছিল ১৩ খণ্ড, তাতে তিনি সই করেছিলেন ১৩ বার। বাড়িটির প্রবেশমুখের হলওয়েতে ছিল ১৩টি সিলিং প্যানেল, সারাহর পছন্দের বিশেষ একটি জানালায় ছিল ১৩টি নীল এবং অ্যাম্বার পাথরের কারুকাজ, বিভিন্ন ক্লজেটে ছিল ১৩টি হুক, সিংকে ছিল ১৩টি করে ফুটো। ১৩ নম্বর বেডরুমে ছিল মাকড়সার জালের মোটিফ, যা বাড়ির অন্য কিছু জায়গাতেও পাওয়া যায়। এমনকি পুরো বাড়িতে বাথরুমও ছিল ১৩টি।

সারাহ উইনচেস্টার চরম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। বাড়িতে তার একটি ব্যক্তিগত প্রেতসভার কক্ষও ছিল।



শোনা যায়, তিনি প্রতিরাতে বাড়ির নীলনকশা নিয়ে ঐ কক্ষে ঢুকে আত্মাদের সাথে আলাপ করতেন পরেরদিনের কনস্ট্রাকশনের ব্যাপারে। বাড়ির কিছু দরজা দিয়ে কোনো কক্ষে ঢোকা যেতো না, আবার কিছু সিঁড়ি সরাসরি ছাতে গিয়ে ঠেকতো। প্রেতসভা কক্ষের পাশে একটি ঘরের কোনো ছাত কিংবা মেঝে ছিলো না। অতৃপ্ত আত্মাদেরকে বিভ্রান্ত করে দেবার জন্যই হয়তো সারাহ এই বিশাল গোলকধাঁধাটি বানিয়ে যাচ্ছিলেন। বাড়ির আসল নীলনকশাটি অবশ্য কখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

অনেকে মনে করেন, সারাহ আসলে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই এরকম উদ্ভট বাড়ির কাজটি করেছিলেন। কেননা এই নির্মাণকাজের ফলে সান জোসের অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিলো, আবার তাদের বেতনও নাকি ছিল প্রচলিত বেতনের প্রায় তিনগুণ। এমনকি সারাহ তার স্বামীর নামে একটি হাসপাতালও বানিয়েছিলেন। তবে এই বাড়িটিই তার সবচেয়ে বড় সমাজসেবামূলক কাজ। খামখেয়ালী সারাহ সবার থেকে কিছুটা আলাদা থাকলেও নিঃসঙ্গ ছিলেন না। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক ১৮ জন সহকারী এবং ১৮ জন মালী থাকতেন। সেইসাথে রাজমিস্ত্রিরা তো ছিলই। তিনি বাগান করাও খুব পছন্দ করতেন। ১৯২২ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সারা উইনচেস্টার মারা যান। মারা যাবার পরে তার প্রবল সুরক্ষিত ভল্টটি খোলা হয়। অনেকেই ভেবেছিলো ভেতরে রাশি রাশি ডলার পাওয়া যাবে। কিন্তু ভেতরে কেবল তার মেয়ের এক গাছা চুল আর স্বামীর ব্যবহার্য কিছু জিনিস বাদে আর কিছু পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন সময়ে দর্শনার্থী এবং কর্মীরা এই বাড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা, নিজের নাম ধরে ডাকা, ঘরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া, গায়ে অদৃশ্য কারো ছোঁয়া লাগার মতো ভুতুড়ে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন।

বিখ্যাত জাদুকর ‘হ্যারি হুডিনি’ বাড়িটিকে ঘিরে থাকা সকল কুসংস্কারকে ভেঙে দেবার জন্য এখানে এক রাত থাকতে রাজি হন।  প্রেতসভাকক্ষে বসে তিনি প্ল্যানচেটের আয়োজনও করেছিলেন। কিন্তু চলে যাবার সময় হুডিনি জোর দিয়ে বলতে পারেননি যে বাড়িটিতে কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই। এমনকি “উইনচেস্টার মিস্ট্রি হাউজ” নামটিও দিয়েছিলেন হুডিনি নিজেই। এই নামেই পরবর্তীতে বাড়িটি সকলের কাছে পরিচিতি পায়।

 


আধুনিক প্রযুক্তির স্বর্গ ‘সিলিকন ভ্যালি’র মধ্যে অবস্থিত হলেও এই বাড়িটি সবসময় যুক্তির বাইরেই থেকে গেছে। রহস্য এবং অনন্য ইন্টেরিয়র দুই মিলিয়েই এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে বহুদিন ধরে। ২০১৮ সালে এই বাড়ির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি হরর সিনেমা “উইনচেস্টার”।

 

যুগ যুগ ধরে এক অদ্ভুদ রহস্যে মোড়ানো এই বাড়িটি একবার হলেও কাছ থেকে দেখা উচিত।

মতামত

0Comments

আপনার মতামত লিখুন (0)

#buttons=(ঠিক আছে!) #days=(20)

এই ওয়েবসাইটি ব্যবহারে আপনার অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য কুকিজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমরা কখনই আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার কোনো ডাটা সংরক্ষণ করব না। আরো জানুন
Ok, Go it!