রহস্যময় পৃথিবীতে রহস্যের কোনো শেষ নেই। তার মধ্যে একটি হচ্ছে 'ভূত'। ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে যেমন সহস্র পুরনো বিতর্ক চলে আসছে, তেমনই আবার নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটছে আমাদের চার পাশে। এসব ঘটনা এতটাই অদ্ভুত যে, এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে এগুলোকে বলা হয় ভূতুড়ে কাণ্ডকীর্তি। এসব ভূতুড়ে কাণ্ড থেকে রক্ষা পায়নি গভীর সমুদ্রে ভেসে চলা জাহাজগুলোও। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে অনেক জাহাজ, নিশ্চিহ্ন হয়েছে শত শত যাত্রী। তবে হারিয়ে যাওয়া কিছু জাহাজ প্রায়ই ভেসে ওঠে সমুদ্রের বুকে!
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
অনেকেই হয়তো ভূত-প্রেত বিশ্বাস করেন না। তবে অতিপ্রাকৃত অনেক ঘটনার সমাধান আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরাও করতে পারেননি। বিশ্বের আনাচে-কানাচে অনেক রহস্যময় ঘটনা প্রতিদিন ঘটে চলেছে, যার ব্যাখ্যা জানা নেই কারও।
ঠিক তেমনই মাঝসমুদ্রে অসংখ্য অতিপ্রাকৃত ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই। মাঝসমুদ্র থেকে অদৃশ্য হওয়া জাহাজ সম্পর্কে কখনো শুনেছেন? এমন কয়েকটি বিস্ময়কর কাহিনি আছে, যা হয়তো আপনার অজানা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরাও।
হয়তো ভাবছেন, জাহাজগুলো যাত্রীসহ ডুবে গেছে! তেমনটিও ঘটেনি। কারণ জাহাজগুলো যদি ডুবে যেত, তাহলে কেউ না কেউ অন্তত বেঁচে যেত অথবা আশেপাশের জাহাজগুলো তা জানতে পারত। তেমন কিছুই জানা যায়নি রহস্যময় এসব জাহাজ সম্পর্কে। অথচ এসব জাহাজকে প্রায়ই মাঝসমুদ্রে দেখতে পাওয়া যায়। জাহাজগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে যাত্রী নিয়ে! এজন্য অনেক নাবিকই জাহাজগুলোকে ভুতুড়ে বলে দাবি করেছেন। তেমনই কয়েকটি জাহাজের করুণ পরিণতি সম্পর্কে জেনে নিন-
এল ক্যালুচে: ‘বাতাসহীন এক রাতে হঠাৎ এল ক্যালুচে এক জাহাজের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। ভুতুড়ে ওই জাহাজ থেকে গানের সুর ও মানুষের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।’ এমনই মন্তব্য করেন কয়েকজন নাবিক। চিলির উপকূলের দিকে এল ক্যালুচে যাচ্ছিল তখন। দূর থেকে জাহাজটি কেউ দেখতে পায় না। কুয়াশার মাঝ থেকে হঠাৎই জাহাজটি ভেসে ওঠে আবার সেভাবেই মিলিয়ে যায়। স্থানীয়দের দাবি, জাহাজটি অন্যান্য জাহাজকে সাহায্য করে। যারা সমুদ্র এবং এর বাসিন্দাদের ক্ষতি করতে চায়; তাদের শাস্তি দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজটির ক্রু ও নাবিকরা যাত্রী নিয়ে চিলির এ উপকূলীয় এলাকায় ডুবে মারা গিয়েছিল।
এরেবাস অ্যান্ড টেরর: ১৯৪৫ সালের ১৮ মে গ্রেট ব্রিটেন থেকে রাজকীয় জাহাজ ‘এরেবাস অ্যান্ড টেরর’ কানাডার আর্টিকের উদ্দেশে ইংল্যান্ডের উপকূল ছেড়ে যায়। স্যার জন ফ্র্যাঙ্কলিনের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক অভিযানটি নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজের জলসীমাকে পেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে মারাত্মক ভুলের কারণে ১৩৪ জন সেনা ও নাবিকদের মধ্যে কেউ আর ফেরেননি। পরে উদ্ধার মিশনে অংশগ্রহণকারীরা আবিষ্কার করেন, জাহাজটি সম্ভবত কিং উইলিয়াম দ্বীপের কাছে একটি বরফের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সেখানেই ডুবে আটকে পড়েছিল। তবে উদ্ধার করা যায়নি জাহাজটি। জাহাজটিকেও অনেকেই মাঝসমুদ্রে এখনো দেখতে পান!
ইউরিডাইস: ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ জাহাজ আকস্মিকভাবে বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। জাহাজটিতে ক্রু, নাবিকসহ ৩৬৬ জন যাত্রী ছিলেন। এ দুর্ঘটনায় ৩৬৪ জন মারা যান, বেঁচে ফেরেন মাত্র দুই জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরফখণ্ড নয় বরং আইল অব ওয়াইটের কাছে ভেসে বেড়ানো এক ভুতুড়ে জাহাজের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। ওই ভুতুড়ে জাহাজটির নাম ‘ইউরিডাইস’। রহস্যময় জাহাজটিকে অনেকেই সমুদ্রের পাশাপাশি স্থল থেকে ভাসতে দেখেছেন। ১৯৩০ সালে একটি ব্রিটিশ সাবমেরিনও রহস্যময় এ জাহাজের মুখোমুখি হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৮ সালে একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম শুটিংরত যাত্রীরা তাদের নিজের চোখে জাহাজটিকে সমুদ্রে দেখেন!
মেরি সেলেস্টে: ১৮৭২ সালের ৪ ডিসেম্বরে একটি ব্রিটিশ ব্রিগেন্টাইন দল আজোরেসের কাছাকাছি আবিষ্কার করে ‘মেরি সেলেস্টে’ জাহাজকে। যেখানে কোনো ক্রু ছিল না; এমনকি যাত্রীরাও, একাই জাহাজটি ভেসে চলছিল! এমনটিই জানায় ওই ব্রিগেন্টাইন দল। জানা যায়, মেরি সেলেস্টে জাহাজটি সর্বশেষ যেদিন সমুদ্রে যাত্রা শুরু করে; সেদিন তাতে ১০ জন যাত্রী ছিল। তাদের সন্ধান পরবর্তীতে আর মেলেনি। তবে জাহাজটি সত্যিই সমুদ্রে ভেসে ছিল। কিন্তু এতে একটি লাইফবোট নিখোঁজ ছিল। জাহাজে থাকা খাবারসহ অ্যালকোহল কিছুই পাওয়া যায়নি পরবর্তীতে। তবে এর যাত্রী বা ক্রুরা কোথায় গেছে, জানা যায়নি আজও। উদ্ধারের পর জাহাজটিকে জিব্রাল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করে। তারাও নিখোঁজ যাত্রীদের কোনো সূত্র খুঁজে পাননি। এরপর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে, জাহাজটিতে জলদস্যুরা আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে মেরে ফেলেছে। তবে এর সত্যতা আজও জানা যায়নি!
দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান: ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’ কোনো জাহাজের নাম নয়, এটি নাবিকের নাম। বিখ্যাত কিংবদন্তি ক্যাপ্টেন হেনড্রিক ভ্যান্ডারকেন তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ১৭তম শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্লাইং ডাচম্যান। সমুদ্রযাত্রার সময় কেপ অব গুড হোপের কাছে এসে হিংস্র ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন নাবিক। দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন অনেক চেষ্টা করেও জাহাজ ও যাত্রীদের বাঁচাতে পারেননি। জাহাজটিকেও না-কি মাঝসমুদ্রে অনেকবার দেখা গেছে! জনি ডেপের বিখ্যাত সিনেমা ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়ান’ এর দুটো কিস্তিতে দ্য ফ্লায়িং ডাচম্যানকে ফিকশনাল চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।
লেডি লোভিবোন্ডঃ ভুতুড়ে
জাহাজের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের দিনপুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। বিশ্বের আলোচিত সব ভুতুড়ে
জাহাজের অধিকাংশই যুক্তরাজ্যের। আর এর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত একটি জাহাজ হচ্ছে লেডি
লোভিবোন্ড। এই
জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন সাইমন রিড। ১৭৪৮ সালে ক্যাপ্টেন সাইমন রিড তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে
নিয়ে পর্তুগালের উদ্দেশে রওনা হন। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজে চড়ে নতুন স্ত্রী ও অন্যান্যকে নিয়ে
নিজের বিয়ে উদযাপন। কিন্তু
জাহাজের আরেক কর্মকর্তা জন রিভারস সাইমনের স্ত্রীর প্রেমে পড়ে যান। তিনি নব-দম্পতির প্রেম সহ্য
করতে পারলেন না। ফলে জন
সাইমনকে খুন করে জাহাজের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এরপর রহস্যজনকভাবে একে একে মারা যায় সবাই। বলা হয়ে থাকে, প্রতি ৫০ বছর
পর পর নাকি জাহাজটির প্রেতাত্মা সমুদ্রে ভেসে ওঠে। সেই ভেসে ওঠে মৃত
মানুষগুলোও।
ভূতুড়ে জাহাজ কন্সেপ্টটিকে কেন্দ্র করে ‘ট্রায়াঙ্গল’, ‘ঘোস্ট শিপ’ সহ আরো বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে।