বাংলাদেশের চলচ্চিত্র
জগতের এক গর্বিত নাম “শাবনুর”। ৯০ দশকের যতগুলো সিনেমা ছিলো, তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো
শাবনুরের দখলে। শাবনুর মানেই সুপারহিট সিনেমা। রোম্যান্টিক কিংবা পারিবারিক সব সিনেমাতেই
শাবনুর হয়ে ওঠে সেরা। শাবনুরকে বলাই হতো ঢাকাই সিনেমার রাণী। কিন্তু কেনো? আর পাঁচটা
বাংলা সিনেমার মতোই প্রেমের গল্পে অভিনয় করেও শাবনুর কেনো সবার থেকে আলাদা? দর্শক শাবনুরের
মাঝে আলাদা এমন কিইবা পেয়েছিলো, যে কারণে শাবনুরের প্রতিই বেশি আকর্ষন? শাবনুরের এমন
কী আছে যা অন্য নায়িকাদের নেই?
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
কিছু কিছু মানুষের জীবনে, ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল। শাবনুরের সেই কান্নাভেজা চোখে ভুল প্রেমের মাশুলের কথা আমাদের অনেকেরই জানা। মিষ্টি হাসির সেই স্নিগ্ধতা, নীল চোখের অপলক চাহুনি, সাথে তার মায়াবী চেহারা এসবের সংমিশ্রণে শাবনুর যে কোটি হৃদয়ে বাসা বেঁধেছিলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শাবনুরকে বলা হয় ঢাকাই সিনেমার রাণী। পুর্নিমা, পপি, মৌসুমী এদের থেকে শাবনুর কেনোইবা ছিলো আলাদা? আর কিভাবে শাবনুর সকলের স্বপ্নে জায়গা করে নিয়েছে?
৮০ থেকে ৯০ দশককে
বলা হয়ে থাকে বাংলা সিনেমার স্বর্নালী যুগ। সেসময় সিনেমায় দেখা যেত শাবানা, কবরী, ববিতাদের
মতো নায়িকাদের দাপট। হঠাতই উদয় হলো এক নতুন মুখ। শাবনুর। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহর সাথে
“তুমি আমার” সিনেমায় শাবনুরের অভিনয় বেশ প্রশংসিত। সেই সিনেমায় শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর
পুরষ্কারও পান তিনি। সকলের নজর পড়ে শাবনুরের দিকে। এরপর একে একে পর্দায় তার রাজত্ব
চলতেই থাকে।
আসলে শাবনুরের ব্যতিক্রমধর্মী
অভিনয় সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো। আর তিনি খুব সহজেই চরিত্রকে নিজের ভেতরে
রোপণ করতে পারতেন। ফলে তার অভিনয় দর্শককে বাস্তবতার স্বাদ দিতো। আর তাই দর্শক তার অভিনয়
জাদুতে মুগ্ধ হয়ে ফের এক নজর দেখার জন্য ছুটতো সিনেমা হলের দিকে।
পরিচালকরাও যেন শাবনুরকে নিয়ে একটু আলাদাই ভাবতেন। আর সেকারণেই তার সিনেমায় ঢেলে দিতেন সবকিছু। কি নেই শাবনুরের সিনেমায়? সিনেমার গল্পের সাথে মিল রেখে গান, সেই গানের তালে ছিলো মানানসই নাচও। পাকা অভিনেত্রীর মতো নাচটাকেও শাবনুরের বেশ ভালোই রপ্ত করেছিলেন। শাবনুরের সিনেমা ছিলো আগাগোড়া পুরদস্তুর কমার্শিয়াল। নাচ, গান, একশন, সাথে রোমান্স। এই নায়িকার জুটি ছিলো অনেকের সাথেই। সবার সাথেই সে করেছে সাবলীল অভিনয়, পর্দায় জমিয়েছে প্রেমের রসায়ন।
শাবনুর-সালমান শাহ
জুটি ছিলো দর্শকের বেশ পছন্দের। তবে সালমান শাহর অকাল মৃত্যুতে সেই জুটি অল্পদিনেই
ভেঙে যায়। দর্শকের সাথে সাথে ভেঙে পড়েন নায়িকা নিজেও।
অনেকেই ভেবেছিলো সালমানের মৃত্যুর পর শাবনুরের ক্যারিয়ারে হয়তো ধ্বস নামবে। কিন্তু ঘটনা ঘটে পুরোই উল্টা। যেকোন নায়কের সাথেই শাবনুরের জুটি হয়ে ওঠে হিট। দর্শক চায় শাবনুরকে। শাবনুর আসে। এবার তার পার্টনার হয় রিয়াজ। রিয়াজের সাথেই সবচেয়ে বেশি পর্দায় দেখা গিয়েছিলো শাবনুরকে। রিয়াজ ছাড়াও ওমর সানী, বাপ্পারাজ, শাকিব খান, ফেরদৌস এদের সাথেও শাবনুরের জুটি ছিলো অনবদ্য। শাবনুর দর্শক চোখেও হয়ে ওঠে স্বপ্নের নায়িকা। সেই স্বপ্নের নায়িকা শুধু রোমান্টিকতায় নয়, পারিবারিক সিনেমাতেও যিনি ছিলেন দুর্দান্ত।
আমার মতে শাবনুর হলো
একটা তরলের মতো। যে পাত্রেই রাখা হোক না কেনো, সেই পাত্রের আকারই ধারন করে নেয় সে।
কখনো সে হালকা পাতলা
গড়নের গ্রামের মেয়ে “সখী”, আবার কখনো ধনীর দুলালী “অন্তরা”।
শাবনুরের বেশ কিছু
সিনেমায় ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনীও দেখা গিয়েছে। শাবনুর সেখানেও করেছে বাজিমাত।
কিন্তু, শুধু এতটুকুই
কি যথেষ্ঠ একজন সফল অভিনয়শিল্পী হতে? হয়তো ‘হ্যাঁ’। তবে শাবনুর যে শুধু সফল অভিনয়শিল্পীই
ছিলেন না, তার প্রমান সে নিজেই। শুধুই যে নাচ গানে ভরপুর ধুমধারাক্কা সিনেমাতেই শাবনুর
অভিনয় করেছে, তা কিন্তু না। কমার্শিয়াল সিনেমার বাইরে সাহিত্য নির্ভর কিছু সিনেমাতেও
শাবনুরকে দেখা গেছে। তবে সাহিত্যভিত্তিক সিনেমায় শাবনুর যেন পুরোটাই চেঞ্জ।
হুমায়ুন আহমেদের “জনম জনম” উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত “নিরন্তর” সিনেমায় দেখা যায় ভিন্ন এক শাবনুরকে। সিনেমায় ‘তিথি’ চরিত্রটাকে যেন তিনি নিজের ভেতরেই জন্ম দিয়েছেন। কিভাবে একটা মেয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে নিয়ে ভাবে, সেটাই শাবনুর ফুটিয়ে তুলেছে তার অভিনয়ে। এই সিনেমায় শাবনুরের বলা একটি ডায়লগ দর্শক মনে যেমন গেঁথেছিলো, তেমনি নাড়িয়ে দিয়েছিলো পুরো সমাজকেই। এছাড়াও বেশ কয়েকটা সিনেমাতেও শাবনুরকে দেখা গিয়েছে একদমই ভিন্ন চরিত্রে। যেসব চরিত্র শাবনুর নিজের ভেতরে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আসলে শাবনুর তার সাবলীল অভিনয়, চরিত্রের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এসব গুণের কারণেই অন্য সকলের থেকে আলাদা হয়েছেন। শাবনুরের অভিনয়ে চলচ্চিত্র যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে তেমনি তিনি নিজেও পেয়েছে চলচ্চিত্রে আলোচিত থাকার চিরস্থায়ী আসন।