হৃদয়
নেই, নেই মস্তিষ্ক। মেরুদন্ড নেই, নেই রক্ত। বাস করে পানিতে। এমন কোনো প্রানী কি হতে
পারে?
এই
বিশাল প্রকৃতিতে কতো বিচিত্র প্রানীর বাস। বলছিলাম জেলিফিশের কথা। উজ্জ্বল রঙের তলতলে
নরম ভেসে বেড়ানো এই জলচর। নামের সঙ্গে “ফিশ” থাকলেও আদতে এরা কিন্তু অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
ঘণ্টার মতো দেখতে জেলীসদৃশ প্রাণীটি প্রাণীজগতের নিডারিয়া পর্বের সিফোজোয়া শ্রেণীর
অন্তর্গত। ৫ হাজার কোটি বছর ধরে সাগরে এদের বাস। মহাসাগর থেকে গভীর সমুদ্রতীর অঞ্চল
সর্বত্র এদের পাওয়া যায়। ম্যাসোগলিয়া নামে এক ধরনের জেলি জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী এদের
শরীর। শরীরে ৯৫ শতাংশই জল। জেলিফিশের জীবন কয়েকঘন্টা এমনকি কয়েকমাসও হতে পারে। আবার
অমর জেলিফিশও আছে। যারা বয়সের কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। জীব জগতে একমাত্র
জেলিফিশেরই এই ক্ষমতা আছে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
জেলিফিশের
অদ্ভুদ আকার আর চকচকে রং যতই আকৃষ্ট করুক না কেন, কিছু প্রজাতির জেলিফিশ খুব ভয়ংকর
হয়। এদেরকে “বক্স অব ডেথ” বলা হয়। এদের লম্বা কর্ষিকা দিয়ে নেমাটোসিস্ট ও বিষ বহন করে।
হুল এতটাই বিষাক্ত যে সাপের বিষকেও হার মানায়। মাত্র চার মিনিটের মধ্যে শিকারকে প্রাণে
শেষ করার ক্ষমতা রাখে এরা। সমুদ্র স্নানে আসা মানুষদের কাছে জেলিফিশ যেন এক আতঙ্কের
নাম। জেলিফিশ প্রজাতির মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান বক্স জেলিফিশ সবচেয়ে বিপদজনক। এদের বিষাক্ত
হুলের আক্রমণে চোখের নিমিষে প্যারালাইসিস, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট থেকে মৃত্যু পর্যন্ত
ঘটতে পারে।
বিজ্ঞানীরা গবেষনা করেন জেলিফিশের উজ্জ্বলতা নিয়ে। অনেকটা জোনাকির মতো জ্বলজ্বলে হয়ে থাকার কারণ হিসেবে জেলিফিশের ভেতরে তারা খুঁজে পান একটি বিশেষ প্রোটিন যার নাম দেওয়া হয় “গ্রিণ ফ্লুওরেসেন্ট প্রোটিণ”। পেলাগিয়া নকটিলুকা জেলিফিশেরা নিজেদের শরীরে আলো উৎপন্ন করতে সক্ষম। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় “বায়োলুমিনোসেন্স”। এর ফলে তাদের সৌন্দর্য বেড়ে উঠে কয়েকগুণ। জেলিফিশ আলো ছড়ালে সমুদ্রকে অপার্থিব এক সৌন্দর্য আচ্ছন্ন করে ফেলে।
শরীরের
শক্তি ব্যবহারে জেলিফিশ খুবই পারদর্শী। এরা পানির নিচে চলাচলের সময়, নিজের শরিরটাকে
গুটিয়ে নিয়ে পেছনের দিকে ধাক্কা দেয়। ফলে পেছনে পানির একটা ঘুর্ণন তৈরি হয়ে জেলিফিশকে
সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। এভাবেই শরীরের ১% পেশী নিয়েও এরা দিব্যি চলাচল করতে পারে।
আর চলাচলে এত কম শক্তি ব্যয় হবার কারণে জেলিফিশ নিজের বেড়ে ওঠায় এবং বংশবৃদ্ধির দিকে
অনেকটা বেশি শক্তি ব্যয় করতে পারে। এ কারণে তারা সহজেই বাড়তে বাড়তে দখল করে নেয় অনেকটা
এলাকা। ফলে পানির অন্যান্য জীবের সংখ্যা কমিয়ে দেয় এরা।
খুব
সুন্দর এই প্রাণীটিকে জলে সাঁতার কাটতে কাটতে ধরে একটু আদর করতে চাইলেও ভুলেও সেটা
করা যাবে না। সাধারণ একটা জেলিফিশের টেন্টাকলের খোঁচা ত্বকে লাগলে বাজে একটা চুলকানি
হয়। কিন্তু বক্স জেলিফিশের ক্ষেত্রে এমন একটি খোঁচা খেলে মৃত্যু হবে তিন মিনিটের মাথায়।
ফিলিপাইনে প্রতি বছর ২০-৪০ জন মানুষ মারা যায় এর কারণে।
পৃথিবীর
যে ক’টি প্রাণীর মহাকাশে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে, তাদের মধ্যে জেলিফিশ অন্যতম। ১৯৯১ সালে
‘স্পেস শাটল কলম্বিয়া’র মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ২,৪৭৮টি জেলিফিশকে মহাকাশে প্রেরণ করেন।
এর মাধ্যমে তারা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, মহাশূন্যের অভিকর্ষ বলহীন স্থানে জেলিফিশের
কীরূপ পরিবর্তন ঘটে।
সবাইকে অবাক করে, জেলিফিশ সেখানে তার সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল, যার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৬০,০০০ এর কাছাকাছি। পৃথিবীতে জেলিফিশগুলোকে ফিরিয়ে আনার পর দেখা গেল, যে জেলিফিশগুলো মহাশূন্যে জন্ম নিয়েছিল, তারা পৃথিবীর অভিকর্ষের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।
জেলিফিশের শরীর একেবারেই সরল। একে দেখে কখনো ভেবেছেন, এর মুখ কোথায় আর পায়ু কোথায়? ভাবার কিছুই নেই। এর মুখ এবং পায়ু আলাদা নয় বরং একই!