প্রত্যেক নেক আমলের বিভিন্ন
ফজিলত ও সওয়াব রয়েছে। যা দ্বারা মহান রাব্বুল আলামিন আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু
রোজার বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের
প্রত্যেকটি আমলকে আল্লাহ তায়ালা বৃদ্ধি করে দেবেন। একটি নেকি ১০ গুণ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে
৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু রোজার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ, রোজা একমাত্র
আল্লাহর তায়াল জন্য। সুতরাং এর প্রতিদান হবে অগণিত। (সহিহ বোখারি : ১৮৯৪, সহিহ মুসলিম
: ১১৫১/১৬৪)। আর একারণেই রোজা মুসলমানদের জন্য একটি অপরিহার্য ইবাদত।
প্রতি বছর পবিত্র এই রমজান
মাস আমাদের মাঝে নিয়ে আসে একটি অন্যরকম জীবনধারা। আমরা সকলেই যেন নিজেদের মাঝে একটা
সংযমী জীবন-যাপন ধারণ করি। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে আমাদের প্রধান আকর্ষণ হয়
ইফতার। আর তাই যে যার সাধ্যমত চেষ্টা করে ইফতারকে বর্ণাঢ্য করতে। সাধারণত আমাদের দেশের
ইফতারিতে খেঁজুর, ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, হালিম, জিলাপি এসবই বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও
পাশাপাশি থাকে নানা ধরনের পুষ্টিকর ফল। অনেকেই আবার ইফতারিতে ভারি খাবারও পছন্দ করেন।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইফতারের ধরন ভিন্ন রকম। আবার অঞ্চলভেদে একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন
রকম ইফতারও হয়ে থাকে। তবে চলুন জেনে নিই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানরা ইফতারে কি
কি খেয়ে থাকে?
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
ভারত
ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪.২%
মুসলিম। পবিত্র এই রমজান মাসে ভারতের মুসলমানরা সাধারণত তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়েই
ইফতার করতে বেশী পছন্দ করেন। তবে এখানে অঞ্চল ভেদে আছে ভিন্নতা। যেমন; হায়দ্রাবাদে
ইফতারির জনপ্রিয় খাবার হালিম। অন্যদিকে তামিলনাড়ু ও কেরালায় চাল, সবজি ও মাংস দিয়ে
তৈরি ‘ননবো কাঞ্জি’ বেশ জনপ্রিয়। কলকাতায় আবার ইফতারিতে বিভিন্ন ধরনের কাবাবের বেশ
চাহিদা। এছাড়াও চিকেন শর্মা, বটি কাবাব, লাহোরি মাটন, খাসীর মগজের কাটলেট, খাসীর লেগ
রোস্ট ইত্যাদি হরেক রকমের খাবারের চল রয়েছে ভারতীয় ইফতারিতে।
পাকিস্তান
মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তান
এই রমজান মাসকে বেশ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালন করে থাকে। আর তাদের ইফতারিতেও থাকে
হরেক রকম আয়োজন। রুটি এবং মাংস পাকিস্তানিদের প্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাদ্য। সুতরাং ইফতারে
তাদের এই দুটি আইটেম থাকবেই। তবে এছাড়াও পাকিস্তানি ইফতারিতে রয়েছে ব্রেড রোল, টিক্কা
সামোসা, তান্দুরি কাটলেট, ঘিলাফি কাবাব, সফিয়ানি বিরিয়ানি ইত্যাদি। মিষ্টি জাতীয় খাবারের
মধ্যে থাকে বিভিন্ন রকম ফলের সালাদ, করাচি ফালুদা, ইত্যাদি।
দুবাই
আরব বিশ্বের ইফতার সংস্কৃতিতে
অনেকটাই মিল রয়েছে। দুবাই ও সৌদি আরবের ইফতার অনেকাংশে সেইম। দুবাই বাসিরা ইফতারে ভারী
খাবার পছন্দ করেন। তাদের ইফাতারে খেজুর এবং দুধ মাস্ট থাকবেই। ভেড়ার মাংস ও মসুর ডাল
দিয়ে তৈরি একধরনের স্যুপ তারা খেয়ে থাকে ইফতারে। এছাড়াও রয়েছে মাংস দিয়ে তৈরী ভেজিটেবল
রোল ‘মালফুফ’, ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি ‘ওউজি’। মিষ্টি খাবার হিসেবে তারা খেয়ে থাকে চিজ
দিয়ে তৈরি পেস্ট্রি যার নাম ‘কুনাফেহ’।
ইরাক
ইরাকিরা ইফতারে প্রথমত খেয়ে
থাকে খেজুর এবং টক দই দিয়ে তৈরি বিশেষ এক ধরনের শরবত। এর সাথে থাকে মসুর ডালের স্যুপ।
ভারি খাবার হিসেবে তারা খায় সিদ্ধ চালের ভাত এবং সাথে ভেড়া অথবা মুরগির মাংস। সেই সাথে
আছে শরবত। মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে দুধের তৈরি পুডিং ‘মাহাল্লাবি’।
সৌদি আরব
ইসলাম ধর্মের শুরু যেখানে,
সেই সৌদি আরব এ মাহে রমজান ও ইফতার যে বিশেষ ভাবে উদযাপিত হবে তাতে কোন সন্দেহই নাই।
রোযার মাসে সৌদি আরবের বেশিরভাগ অফিস আদালতই ছুটি থাকে। সৌদিরা সাধারনত ইফতারের পর
সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকে। তাই সৌদি ইফতারের আয়োজনটাও হয় অনেক জাঁকজমক পূর্ণ। পুষ্টিকর
খাবারে পরিপূর্ণ সৌদি ইফতারে থাকে উন্নত মানের খেজুর, ভিমতো (আঙ্গুর রসের শরবত), লাবান,
বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, তামিজ ( একধরনের রুটি), বোরাক ( মাংসের পিঠা), মানডি ( মুরগী
ও ভাত দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) অথবা ভেড়া/মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খাবসা।
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া। এই দেশে ২৩ কোটিরও বেশী মুসলিম বাস করে। এখানকার মানুষ ইফতারিতে জনপ্রিয় খবার হচ্ছে ‘কোলাক’, যা তৈরি করা হয়- নারকেল দুধ, চিনি, কলা, মিষ্টি আলু দিয়ে। এই দেশের মানুষ মসলা ছাড়া খাবার খেতে অভ্যস্ত। ইফতারে তারা খুব একটা ভারী খাবার খান না। বিভিন্ন ধরনের জুস, ফ্রুট ককটেল, ডাবের পানি দিয়েই তারা ইফতার করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মালেশিয়া
মালেশিয়ান মুসলমানরা ইফতার সাড়েন আখের রস ও সয়াবিন মিল্ক দিয়ে, যাকে তাদের ভাষায় ‘বারবুকা পুয়াসা’ বলা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় খাবারের মধ্যে থাকে লেমাক লাঞ্জা, আয়াম পেরিক, নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস এবং সাথে অন্যান্য খাবার। মালয়েশিয়ার বেশির ভাগ মসজিদে রোজায় আসরের নামাজের পর স্থানীয়দের ফ্রিতে ‘রাইস পরিজ’ দেওয়া হয়।
জাপান
জাপানের মানুষরা সবসময় স্বাস্থ্যকর
খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাই তারা ইফতারিতে নুডলস, বাঁধাকপি, লম্বা পেঁয়াজ, জাপানি তোফু
এবং পাতলা করে কাটা গরুর মাংস দিয়ে বানানো একধরনের খাবার খেয়ে থাকেন। এখানকার ইফতারে
আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো ‘কাটসু কারি’। আলু, গাজর ও ব্রকলি সাথে মশলা দিয়ে তৈরি করা
হয় এই খাবার। ার এটি খাওয়া হয় ভাত ও চিকেন কাটলেট দিয়ে।
তুরষ্ক
তুরস্কে ইফতার আয়োজনে রাখা হয় পাইড নামের রুটি, মসলা দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস, বিভিন্ন রকমের ফল, সবজি ইত্যাদি। তুর্কিরা ইফতারে মধু খেতে পছন্দ করেন। এছাড়াও জলপাই ও পনির দিয়ে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবারও থাকে তাদের ইফতারে।
মিশর
মিশরীয়রা সাধারণত পানি ও
খেজুর দিয়েই ইফতার শুরু করে থাকে। তাদের প্রধান ইফতার আইটেম পাট শাকের স্যুপ, আঞ্চলিক
ভাষায় এর নাম ‘মা’হসী মলোকাইয়া’। এছাড়াও মাংস ও ঢেঁড়স ভুনা, মিশরীয় আটার রুটি, তাজা
ফল ও পুদিনা পাতার চা ইত্যাদি খাবার দিয়ে সাজানো থাকে তাদের ইফতার। ‘কামার আল দিনান্দ
আরাসি’ নামক বিশেষ ধরনের পানীয় বেশ জনপ্রিয়। মূলত এটি তৈরী করা হয় অ্যাপ্রিকটের খোসা
দিয়ে।
সিরিয়া
হালুয়ার জন্য বিখ্যাত শহর সিরিয়া। সারা বিশ্বেই রয়েছে সিরিয়ানদের তৈরী হালুয়ার কদর। এই খাবারকে তারা নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। ইফতারিতেও সিরিয়ানদের জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে হালুয়া। হালুয়ার সাথে আরো থাকে মধু ও খেজুর।
চায়না
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ
চায়নার মাত্র ২% জনসংখ্যা মুসলিম। দেশটির শিনজিয়াং প্রদেশেই বেশিরভাগ মুসলমান বাস করেন।
এখানকার মুসলমানরা প্রায় ১৭ ঘন্টা পানাহার থেকে বিরত থেকে রোজা পালন করে থাকে। দেশটিতে
ইফতারের সময় স্ট্রিট ফুডগুলো বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। তবে তাদের স্ট্রিট ফুডগুলো আমাদের
দেশের মতো ভাজাপোড়া নিয়ে বসে না। ইফতারে তারা খেয়ে থাকেন সেদ্ধ করা বিভিন্ন সবজি। এছাড়াও
থাকে কাজু বাদাম দিয়ে রান্না করা মুরগি এবং সেই সাথে বিভিন্ন রকমের স্যুপ।