দুই দিন ধরে ফুটবল দেখা বাচ্চারা
হয়তো ম্যান সিটিকে অনেক বড় ক্লাব ভাবে। তবে যে কোনো বিচারেই ইংল্যান্ডের
সবথেকে বড় ক্লাব লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। স্যার আলেক্স যাওয়ার পরে রেড
ডেভিলদের বাজে সময় এখনো চলমান। তবে মাঝে এরথেকেও বাজে সময় কাটিয়েছে লিভারপুল। ১৯৯০
এর পরে টানা ৩০ সিজন ধরে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ছিল অধরা। ঠিক তখনই দেবদূত
হিসেবে আসে ইউর্গেন ক্লপ। তার হেভি মেটাল ফুটবলের হাত ধরেই ১৯-২০ সিজনে লিগ
শিরোপা জেতে লিভারপুল। এরপর তিনি একে একে লিভারপুলকে
জিতিয়েছেন সকল ট্রফিই।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
২০১৩-১৪ সিজন। প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা
জয়ের রেসে এগিয়ে আছে তিনটি ক্লাব – চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি
এবং লিভারপুল। ব্রেন্ডন রজার্সের লিভারপুল শিরোপা জয়ের দৌঁড়ে সব থেকে এগিয়ে। চেলসির বিপক্ষে গেইমউইক
৩৬ এর ম্যাচটি জিততে পারলেই লিভারপুল ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। অলরেডদের ২৪ বছরের আক্ষেপের
পাশাপাশি এই শিরোপা স্টিফেন জেরার্ডের জন্য স্বপ্ন। ক্যারিয়ারের শেষবেলায় দাঁড়িয়ে
তিনি। লিভারপুলের
হয়ে ইউসিএল শিরোপা তুলে ধরলেও প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা এখনো তার কাছে অধরা।
চেলসি বনাম লিভারপুল ম্যাচটির মাত্র
সেকেন্ড হাফ শুরু হয়েছে। মাঝমাঠে থাকা জেরার্ডের কাছে নরমাল একটি পাস এলো। বল নিয়ে কারিকুরি করতে
এক্সপার্ট জেরার্ড সেই বল আয়ত্তে আনার আগেই হোচঁট খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তার চোখের সামনে বল কেড়ে
নিয়ে গোল করে বসলেন চেলসি স্টাইকার ডেম্বা বা। সেই ম্যাচে লিভারপুল হারলো
২-০
তে। পরবর্তী
ম্যাচে আবার ড্র। শিরোপা
জেতার দৌঁড়ে সব থেকে এগিয়ে থাকা লিভারপুল, পিছিয়ে গেল মাত্র দুই ম্যাচের ব্যবধানে। পরের সিজন খেলে স্টিফেন
জেরার্ড অ্যানফিল্ডকে বিদায় জানালেন। তার শেষ ম্যাচে স্টোক সিটির সাথে লিভারপুল
হারল ৬-১ গোলে!
দলের গোলমেশিন সুয়ারেজ পাড়ি জমালেন বার্সেলোনায়, রহিম স্টার্লিংও ক্লাব ছাড়লেন। বেনটেকে ও রিকি ল্যাম্বার্ট চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যর্থ। পরাশক্তি থেকে অতি সাধারণ একটি ক্লাবে পরিণত হল লিভারপুল। আর্চ রাইভাল এভারটনের মাঠে ১-১ গোলে ড্র হবার পর মৌসুমের মাঝপথে বরখাস্ত হলেন কোচ ব্রেন্ডন রজার্স।
এরপর ‘অলরেড’দের ভাঙ্গা নৌকার হাল ধরে অ্যানফিল্ডে আসেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। যিনি ইতিমধ্যেই জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে অসাধ্য সাধন করে এসেছেন। জার্মান ফুটবলের একচ্ছত্র অধিপতি বায়ার্নকে হারিয়ে টানা দুইবার লিগ শিরোপা জিতেছেন। ডর্টমুন্ডকে নিয়ে খেলেছেন ১২-১৩ সিজনের ইউসিএল ফাইনালও। ক্লপ ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন তারুণ্যের ফুটবল ও গেগেনপ্রেসিং। মেরুদণ্ডহীন ও গোল করতে ভুলে যাওয়া মধ্যমসারির একটি দলকে নিয়ে টটেনহ্যামের বিপক্ষে ক্লপের অভিষেক হয়। ক্লপ প্রথম ম্যাচেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি হেভি মেটাল ফুটবলই খেলাবেন এবং লিভারপুলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে গেগেনপ্রেসিং আয়ত্ত্ব করতেই হবে। কিন্তু, ক্লপের ট্যাকটিক্সের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো ফুটবলারও দলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না।
সেই সিজনে ক্লপ বড় কোনো সাইনিং করেন নি। তবে লিভারপুলের খেলায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাদে ম্যানচেস্টার সিটিকে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারানোর ম্যাচেই ক্লপ সমস্ত সমালোচনার জবাব দিয়ে দেন। ফর্মেশন ধরে রেখে প্রেসিং, প্রতিপক্ষের পা থেকে দ্রুত বল কেড়ে নেওয়া, বা প্রতিপক্ষকে প্রতিনিয়ত চাপের মুখে রাখা – ধীরে ধীরে গেগেনপ্রেসিং এর সাথে লিভারপুলের খেলোয়াড়রা অভ্যস্ত হতে শুরু করে। পরের সিজন থেকে ইংলিশ ফুটবল দেখতে শুরু করে ক্লপের রিয়েল ম্যাজিক। দারুণ উপভোগ্য হেভি মেটাল ফুটবল খেলানোর পাশাপাশি স্কাউটিং-এও বিশেষ নজর দেন তিনি। যেহেতু লিভারপুলের মালিকপক্ষ এফএসজি ট্রান্সফার মার্কেটে মোটা অঙ্কের টাকা ঢালতে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না।
বর্তমান ফুটবলে ক্লপের মতো জহুরির চোখ আছে খুব কম ম্যানেজারেরই। দলে থাকা ফুটবলারদের মধ্যে শুধু কৌটিনহো, ফিরমিনো ও হেন্ডারসনকে মনে ধরেছিল ক্লপের। কৌটিনহো যদিও পরে বার্সায় চলে যায়। ট্রান্সফার মানির সেই টাকা চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সিজনগুলোতে তিনি অল্প খরচে লিভারপুলে নিয়ে আসেন মো সালাহ, সাদিও মানে, অ্যালিসন, অ্যান্ড্রু রবার্টসন, ফ্যাবিনহো ও ওয়াইনালডুম মতো ফুটবলারদের। যারা সবাই এখন লিভারপুল লেজেন্ড। এই প্লেয়ারদের নিয়েই লিভারপুলকে আমূল বদলে ফেলেন তিনি। বিটলসের লিভারপুলের বাতাসে তোলেন জার্মান হেভি মেটাল ‘গেগেনপ্রেসিং’ এর সুরের ঝংকার। ক্যারিয়ারের প্রথম বড় দলে আসা সাদিও মানে, ট্রেন্ট, রবার্টসন কিংবা চেলসি রিজেক্ট মো সালাহদের নিয়ে সেই সময়ে বাজি ধরার লোক খুব একটা ছিল না। কিন্তু এরাই ক্লপের গেগেনপ্রেসিং ফুটবলের সাথে নিজেদের দারুণভাবে মানিয়ে নিলেন। তবে ধারালো আক্রমণ ও গোছানো মধ্যমাঠ থাকলেও ক্লপের ডিফেন্স খুব একটা সলিড ছিল না। প্রতি মৌসুমে ধৈর্য্য ধরে ধীরে ধীরে দলকে গড়ে তোলা ক্লপ সব থেকে বড় দাও মেরেছেন এখানে। কোনো দলে একজন খেলোয়াড় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তার স্পষ্ট উদাহরণ ভার্জিল ভ্যান ডাইক এবং অ্যালিসেন বেকার। তারা দুজন এসে লিভারপুলের ভোঁতা ডিফেন্সকে নিমিষেই পাল্টে দিলেন।
এমনকি একজন সেন্টার ব্যাক হয়েও
ইউসিএল জেতা সিজনে ব্যালন ডি’অর জয় থেকে মাত্র ৭ পয়েন্ট দূরত্বে ছিলেন ভ্যান ডাইক। অন্যদিকে অ্যালিসন তো
বিশ্ব ফুটবলেরই অন্যতম সেরা গোলকিপার বনে গেছেন। ২০১৯ এ ইয়াসিন ট্রফি ও ফিফা বেস্ট
গোলকিপার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন গ্লাভ জিতেছেন দুইবার। এছাড়াও
দুই সিজন আগে ওয়েস্ট ব্রমের সাথে ৯৫ মিনিটে কর্নার থেকে আসা বলে হেড দিয়ে গোল করে
লিভারপুলকে ইউসিএলে কোয়ালিফাই করিয়ে হইচই ফেলে দেন অ্যালিসন।
যাই হোক, ক্লপের অধীনে এই দলটাই লিভারপুলকে
৩০ বছর পর ২০২০-এ ইপিএল শিরোপা এনে দেয়। এছাড়াও মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে
দুইবার লিগ শিরোপা হারায় ম্যানচেস্টার সিটির কাছে।
২০১৮-১৯ সিজনে তারা ক্লাবের ইতিহাসের ৬ষ্ঠ ইউসিএল টাইটেল জেতে। এছাড়াও আরো দুইবার ইউসিএল ফাইনালে শিরোপা হারায় ইউরোপিয়ান জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। লিভারপুলের হয়ে টোটাল ৭ সিজনে তিনি এছাড়াও জিতেছেন একটি করে এফএ কাপ, কারাবাও কাপ, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, ইউএফা সুপার কাপ ও কমিউনিটি শিল্ড। ক্লপ লিভারপুলকে খেলান ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। যেখানে আক্রমণের মূল ফুলঝুরি ফোটে দুই উইং ধরে। তার দুই ফুলব্যাক ট্রেন্ট ও রবার্টসন, দুজনই প্রচণ্ড পরিমাণে অ্যাটাকিং। এছাড়াও উইং এ থাকা সালাহ ও মানে সে সময়ে ক্রিয়েটিভ স্ট্রাইকার ফিরমিনোকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিল ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে ভয়ংকর অ্যাটাকিং ট্রায়োগুলোর মধ্যে একটি। ক্লপের গেগেনপ্রেসিং এর মূলমন্ত্রই হচ্ছে ননস্টপ অ্যাটাক এবং প্রেস করে যাওয়া। ক্লান্তির কোন জায়গা নেই তার ফুটবল ফিলোসফিতে। এজন্য তার দলে কয়েক সিজন পর পর দরকার পরে ট্রাঞ্জিশনের। ক্লপের সেই সর্বজয়ী দল থেকে ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন সাদিও মানে, হেন্ডারসন, ওয়াইনাল্ডুম, মিলনার, ফিরমিনোরা। ইঞ্জুরি জর্জরিত টিম নিয়ে লাস্ট সিজনের ফলাফলও হয়নি আশানুরূপ।
ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডে দলে এসেছে ডিয়োগো
জোটা, লুইস ডিয়াজ, ইব্রাহিমা কোনাটে, ডারউইন নুনেজ, কোডি গ্যাকপো, হার্ভি এলিয়ট, ফ্যাবিও কারভালহোর মতো ইয়াংস্টাররা। ডারউইন নুনেজ বাদে
বাকি সবাইকেই ক্লপ দলে নিয়ে এসেছেন রীতিমত পানির দামে। এছাড়াও কার্টিস জোনস,
জারেল কোয়ানসাহ, বেন ডোক, কনর ব্র্যাডলি, স্টেফান বাজসেটিচ ও ববি ক্লার্কদের তুলে
আনা হয়েছে অ্যাকাডেমি থেকে।
গত সিজনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ
মিডফিল্ডের পারফর্ম করতে না পারা। নাবি কেইটা, অক্সলাডে-চ্যাম্বারলেইন, হেন্ডারসন,
ফ্যাবিনহোরা ইঞ্জুরি এবং অফফর্মেই ছিল সিজন জুড়ে। তাই এই সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতে
ক্লপ দলে ভিরিয়েছেন আর্জেন্টাইন বক্স টু বক্স ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার আলেক্সিস ম্যাক
অ্যালিস্টার, ডাচ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার রায়ান গ্র্যাভেনবার্চ, জাপানি ডিফেন্সিভ
মিডফিল্ডার ওয়াতারু এন্ডো এবং হাঙ্গেরিয়ান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ডমিনিক
সবোস্লাইকে। এই সিজনে এখনো পর্যন্ত লিভারপুল আছে প্রিমিয়ার লিগ টেবিলের ১ নম্বরে।
দাপটের সাথে পৌছে গেছে ইউরোপা লিগের রাউন্ড অফ সিক্সটিনে। এমনকি এফএ কাপে আছে
ফোর্থ রাউন্ডে ও ক্যারাবাও কাপে ইতিমধ্যেই চলে গেছে ফাইনালে। অর্থাৎ কোয়াড্রাপলের
স্বপ্ন বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে তাদের। যদিও ইউসিএলের জায়গায় ইউরোপা লিগের শিরোপা
সেই গৌরবকে অবশ্যই কিছুটা কমাবে। তবে দেখার বিষয়, সিজনের শেষ পর্যন্ত তরুণ
তুর্কিরা সালাহ-অ্যালিসন-ভ্যান ডাইকদের সাথে নিয়ে হেভি মেটাল ফুটবলের হাই নোটকে
কতটা উপরে তুলতে পারেন।
তবে যত যাই হোক, লিভারপুলের আর্চ রাইভাল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কট্টর ফ্যানরাও এটা স্বীকার করবে যে, আজ লিভারপুলের এই সাফল্যের পেছনে ইয়ুর্গেন ক্লপের ব্রেইন এবং ফুটবল ফিলোসফির অবদান সবথেকে বেশি। লিভারপুল বোর্ড তার উপরে চোখ বুঝে আস্থা রাখতে পারে। গত সিজনে বাজে পারফর্মের পরেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ বলেছে ক্লপ চাইলে আজীবন লিভারপুলের কোচ হিসেবে থাকতে পারে
২০১৫ সালে উঠতি কোচ হিসেবে
মধ্যমমানের একটি দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি বিশ্বের সেরা কোচদের একজন, লিভারপুল ইউরোপের
অন্যতম জায়ান্ট ক্লাব। ইউরোপের যে কোন বড় দলের
অ্যানফিল্ডে পা রাখতে গেলে আত্মা কাঁপে। মাঠের হেভি মেটাল ফুটবলের সাথে সমানতালে
গ্যালারি থেকে ভেসে আসে –
“Walk on, walk on
With hope in your heart
And you'll never walk alone
You'll never walk alone.”