মিশরকে নিয়ে খুব বেশি না জানলেও মিশরের পিরামিডের কথা অনেকেই শুনেছেন। ত্রিভুজাকৃতির এই স্তম্ভগুলো যতটা আকর্ষনীয়, তার চাইতেও বেশি রহস্যেঘেরা। পিরামিডগুলোর সামনে দাঁড়ালে যে কারও মনে প্রথমেই প্রশ্ন জাগবে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫ হাজার বছর আগে এত সূক্ষ্ম নির্ভুল জ্যামিতিক মাপের পিরামিডগুলো কিভাবে বানানো হয়েছিলো? পাথরগুলোইবা কাটা হয়েছিলো কীভাবে?
মিশরের কায়রোর নীল নদের প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে গিজা মালভূমিতে অবস্থিত গিজা'র পিরামিড। ধারনা করা হয়, পিরামিডটি ২৫৫০ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ রাজবংশের দ্বিতীয় ফারাও 'খুফু'র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এটি মিশরের সবচেয়ে বৃহত্তম, প্রাচীন এবং আকর্ষনীয় পিরামিড। পিরামিডটি চুনাপাথর এবং গ্রানাইট ব্লক দিয়ে তৈরি এবং এটি তৈরি করতে ২০ বছরের বেশি সময় লেগেছে বলে অনুমান করা হয়। পিরামিডটির উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট এবং এটি প্রায় ৭৫৫ বর্গফুট জমির ওপরে নির্মিত। পিরামিডটি তৈরিতে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছিলো, তার এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মতো। বর্তমান সময়ে 'বুর্জ খলিফা'র ওজন যেখানে ৫ লাখ টন, সেখানে এই পিরামিডের ওজন ৬০ লাখ টন। অনেকের ধারনা, মানুষ নয়; এই পিরামিড তৈরিতে রয়েছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রয়োগ।
‘Man fears time, but time fears the Pyramids.’ অর্থাৎ মানুষ সময়কে ভয় পায়। আর সময় ভয় পায় পিরামিড'কে। মিশরের অতি পুরোনো একটি প্রবাদ। যা রটে তার কিছু তো ঘটে। কি এমন ঘটেছে এই পিরামিডকে ঘিরে! সময়ের সাথে সাথে সবই যখন তাসের ঘর, ঠিক তখন সব নিয়মকে উল্টো ঘুরিয়ে দিয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে এই পিরামিড। পিরামিডের সৃষ্টিতত্ব নিয়ে আজও বহু তর্ক বিতর্ক রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, কেনো তৈরি হলো এই পিরামিড?
কেউ কেউ বলে, রাজাদের দেহ সমাধি করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো পিরামিড। আবার কারো কারো মতে, সেই সময়ে পাওয়ার প্ল্যান্ট হিসেবে বানানো হয়েছে এই স্থাপনা। কেউ আবার বলেন, দুর্ভিক্ষের আগে শস্য মজুত রাখার জন্য তৈরি হয় এই পিরামিড। তবে শেষমেশ একটি যুক্তিতে সবাই আস্বস্ত হন যে, মিশরের ফারাও রাজারা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যু পরবর্তী জীবন অনন্ত অসীম। তাদের মতে মৃত্যুর পরে দেহ যদি সংরক্ষিত রাখা যায় তবে আত্মা আবার সেই দেহে পুনরায় ফিরে আসবে। এ কারণে তারা মৃত্যুর আগে নিজেদের জন্য পিরামিড তৈরি করে যেতেন এবং মৃত্যুর পরে মহা ধুমধামে তাদের সেই মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হতো পিরামিডগুলোর ভেতর।
ইজিপ্টের প্রাচীন সাম্রাজ্যের চতুর্থ প্রজন্মের রাজা "খুফু" কে সমাধিস্থ করা হয় গিজার এই পিরামিডের ভেতর। যদিও পরবর্তীতে গবেষণার জন্য যখন এই পিরামিডটির ভেতরে প্রবেশ করা হয়, দেখা যায় ভেতরটা পুরো ফাঁকা। রাজার দেহ চুরি যাওয়া নিয়ে তৈরি হয় এক রহস্য। এছাড়াও আরও বেশ কিছু রহস্য গিজার এই পিরামিডকে নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে, মানুষ নাকি ভিনগ্রহের এলিয়েনের তৈরি এই স্তম্ভ?
গিজার পিরামিড এতটাই নিখুঁত যে, যদি পৃথিবীর উপর থেকে নিচে এবং ডান থেকে বামে রেখা টানা হয়, তাহলে এই পিরামিডটি ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থান করে। এখানেও প্রশ্ন জাগে যে, ৫ হাজার বছর আগে মানুষ কিভাবে পৃথিবীর মাঝখানটা খুঁজে পেল! কিংবা কীভাবে তারা এই কাঠামোটি পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে তৈরি করেছিল? গবেষকদের মতে, লেজার টেকনলোজি ছাড়া এতো নিখুঁত নির্মাণ অসম্ভব। ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার শ্রমিকের প্রতিদিন ১০ ঘন্টা শ্রমে নির্মান হয় এই পিরামিড। ২০ বছরে সময়ে ২ মিলিয়ন পাথরের সাহায্যে এই পিরামিড বানাতে গেলে প্রতি তিন মিনিটে একটি করে পাথর গাথার প্রয়োজন ছিলো। ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগের সেই আমলের ঐতিহাসিক সরঞ্জাম দিয়ে কি আদৌ সম্ভব ছিলো এই অসম্ভব কর্ম?
পিরামিড কে ঘিরে নানান সময় নানান ধরনের রহস্য কথা উঠে এসেছে। এটি নির্মিত হয়েছিলো মমি সংরক্ষণের জন্যই নাকি এর ছিলো অন্য কোনো উদ্দেশ্য? পিরামিডের এত এত রহস্য যে তাকে যতই খোলাসা করার চেষ্টা চলুক না কেনো, সেটি তত বেশিই ধোঁয়াশা হয়ে যায়। আর তাই এই পিরামিড যেন চোখের সামনে থেকেও অগোচরেই রয়ে গেলো শতাব্দীর পর শতাব্দী।