ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে ক্যাপ্টেনের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। দলের প্রয়োজনে অনেক সময় মাঠে ইন্সট্যান্ট ডিসিশন নিতে হয় ক্যাপ্টেনকে। সর্বকালের সেরা ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের প্রশ্নে একেক জেনারেশনের ভক্তরা হয়তো একেক জনকে রাখবেন। কেউ বলবেন স্টিভ ওয়াহ কিংবা স্টিফেন ফ্লেমিং কথা। কেউ বা বলবেন সৌরভ গাঙুলি কিংবা গ্রায়েম স্মিথ এর কথা। কেউ হয়তো বলবেন রিকি পন্টিং কিংবা এমএস ধোনির কথা। তবে সাধারণত ধোনি এবং পন্টিং এর দিকেই পাল্লাটা সবসময় বেশি ভারি থাকে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
রিকি পন্টিংয়ের ক্যাপ্টেন্সিতেই এক সময় ক্রিকেট বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া। সে সময় বিশ্বের যেকোনো ব্যাটিং বা বোলিং লাইন আপকে নিয়েই রীতিমত ছেলেখেলা করতো অজিরা। রিকি পন্টিংয়ের জন্ম ১৯৭৪ সালের ১৯এ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়াতে। পন্টিং ২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দলের এবং ২০০৪ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের ক্যাপ্টেন্সি করেছেন।
১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে ডেবিউ হয় পন্টিংয়ের। ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ওডিআই ক্যাপ্টেন দায়িত্ব দেয়া হয় রিকি পন্টিংয়ের কাধে। পরের বছরই অস্ট্রেলিয়াকে নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপের ট্রফি এনে দেন রিকি পন্টিং। সে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১২১ বলের ১৪০ রানের অপরাজিত ইনিংসের সুবাদে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। সেই ইনিংসের সুবাদে ২০০৩ বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্যা ফাইনাল নির্বাচিত হন রিকি পন্টিং।
২০০৪ সালে স্টিভ ওয়াহ অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের ক্যাপ্টেন্সি ছাড়লে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলেরও ক্যাপ্টেন্সি দেয়া হয় রিকি পন্টিংকে। ২০০৫ সালে পন্টিংয়ের নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে অ্যাশেজ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
পন্টিংয়ের আন্ডারে অস্ট্রেলিয়া দুটি বিশ্বকাপ এবং দুটি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতে। ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৭৭টি টেস্টের মধ্যে ৪৮টিতেই উইনিং টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ২৯এ নভেম্বরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন পন্টিং। ২০১৩ সালের আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ক্যাপ্টেন ছিলেন পন্টিং। যদিও, টুর্নামেন্টের মাঝপথে বাজে ফর্মের কারণে অধিনায়কের পদ থেকে সরে আসেন তিনি। এরপরেই সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন পন্টিং।
রিকি পন্টিং ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট
মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্ব একাদশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোট ৩২৪ ম্যাচে। এর মধ্যে
দলকে জয় এনে দিয়েছেন ২২০ ম্যাচে। আর হারের পরিমাণ মাত্র ৭০। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে
ক্যাপ্টেন হিসেবে ৬৭.৯০ পার্সেন্ট ম্যাচ জিতেছেন তিনি।
অন্যদিকে একমাত্র ক্যাপ্টেন হিসেবে বিশ্ব আসরে তিনটি শিরোপা জেতার অনন্য নজির আছে ধোনির। ২০০৭ সালে জেতেন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ সালে তার হাত ধরে দীর্ঘ খরা কাটিয়ে ভারত পায় ওয়ানডে বিশ্বকাপের ট্রফি। ২০১৩ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপাও উঁচিয়ে ধরতে পেরেছিলেন ধোনি। কঠিন পরিস্থিতিতেও ধোনিকে দেখা যায় নির্বিকার। ইমোশন কন্ট্রোল করে ব্রেইন দিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। এই কারণেই ধোনিকে সেরা বলতে কোন সংকোচ করেন না বেশিরভাগ ক্রিকেট স্পেশালিস্টরা। ২০০৪ এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরে ডেবিউ হয় ধোনির। ২০০৭ সালে প্রথম অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি।
ক্যাপ্টেন হিসেবে যেকোনো রেকর্ডের দিকে তাকালেই তাঁর নাম দেখা যাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে টোটাল ক্যাপ্টেন ছিলেন ৩৩২ ম্যাচে। এর মধ্যে ভারতীয় দলকে জয় এনে দিয়েছেন ১৭৮ ম্যাচে। আর হেরেছেন ১২০ ম্যাচ। ক্যাপ্টেন হিসেবে সাকসেস রেট ৫৩.৬১ পার্সেন্ট। এছাড়াও আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের ক্যাপ্টেন হয়ে খেলেছেন ২২৬ ম্যাচে। জিতেছেন ১৩৩ টি ও হেরেছেন ৯১ টি। ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৫ আসরে ১০ বারই খেলেছেন ফাইনাল! ৫ বার হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। অবিশ্বাস্য রেকর্ড!
উইনিং পার্সেন্টেজের দিক দিয়ে পন্টিং এগিয়ে থাকলেও, ক্যাপ্টেন্সির সব দিক বিবেচনায় ধোনিকেই এগিয়ে রাখতে হয়। ২০১০-১১ সাউথ আফ্রিকা সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ভারত অলআউট হয়ে গিয়েছিলো ১৯০ রানে। সাউথ আফ্রিকা ব্যাটিং এ নেমে মাত্র ৩২ ওভারে ১ বলেই ৫ উইকেট হারিয়ে করে ফেলেছিল ১৫২ রান। জেতার জন্য ১৭ ওভার ৫ বলে ৫ উইকেট হাতে রেখে সাউথ আফ্রিকার তখন লাগতো মাত্র ৩৮ রান। সেই ম্যাচ ধোনির চমৎকার ক্যাপ্টেন্সিতে অবিশ্বাস্যভাবে ১ রানে জিতে যায় ভারত।
এরকম আরো অনেক অসাধারণ সব ম্যাচ এবং মোমেন্ট রয়েছে ক্যাপ্টেন ধোনির। এছাড়াও তার লিডারশিপ কোয়ালিটি, জুনিয়রদের আগলে রাখা, জহুরির চোখে সবার আগেই নতুন প্লেয়ারদের ট্যালেন্ট চিনে ফেলাসহ দারুণ সব গুণ রয়েছে। তার আন্ডারেই ক্যারিয়ারে প্রথম ব্রেকথ্রু পেয়েছে অ্যাশউইন, জাদেজা, দীপক চাহার, মোহিত শর্মা, মুরালি বিজয়, গাইকোয়াড়, শিভাম দুবে, স্যাম কারেন ও পাথিরানার মতো প্লেয়াররা। এছাড়াও তার লিডারশিপেই নিজেদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন রায়ুডু, মঈন আলী, নেহরা, কনওয়ে, উথাপ্পা, রাহানের মতো প্লেয়াররা। ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে ধোনির ইমপ্যাক্ট এবং ফ্যান-ফলোয়িং অতুলনীয়। বলা হয় ইন্ডিয়ানদের কাছে ক্রিকেট অনেকটা ধর্মের মতো। শচীন এবং ধোনি তাদের কাছে ভগবানের মতো।