১২ই জানুয়ারি, ২০০৭। বাংলাদেশ তখন
পলিটিকালি চুড়ান্ত মাত্রায় আনস্ট্যাবল। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ দেশে জরুরি
অবস্থা ঘোষণা করলেন। তখন সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো। প্রধান
উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ফখরুদ্দীন আহমেদকে। ফখরুদ্দীন আহমেদ প্রায় দুই বছর
প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য আসনে ছিলেন। সেই দুই বছর তিনি দেশের পলিটিকাল ফিল্ড রীতিমত
কাঁপিয়ে ফেলেন। প্রায় ১৬০ জন পলিটিশিয়ান ও গভমেন্ট অফিসারের নামে দুর্নীতির মামলা
করা হয়। ইনফ্যাক্ট শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়। যা ছিল
তখনকার প্রেক্ষাপটে মানুষজনের কল্পনারও অতীত। এই দুই বছরে ফখরুদ্দীন আহমেদের
বিভিন্ন কাজ জনগণের প্রশংসা কুঁড়ায়। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের জয়ের মাধ্যমে ফখরুদ্দীন আহমেদের কেয়ারটেকার গভমেন্ট বিলুপ্ত হয়। এখন কথা
হচ্ছে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা কেয়ারটেকার গভমেন্টটা আসলে কি?
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে এমন
একটি সরকার যা বিশেষ প্রয়োজনে কোন রকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়। এবং সেই
সরকার সাধারণ ইলেকশন প্রসেসে কোনো সরকার নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন
করে।
সাবকন্টিনেন্টের মানুষজনের প্রতি
বিশ্বাস করা আসলে কঠিন। তাই নির্বাচনের দায়িত্ব ক্ষমতাশীন দলের হাতে থাকলে সেই
নির্বাচন বায়াসড হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এখানেই দরকার হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। বাংলাদেশের
পলিটিক্সে এই বিতর্কের শুরুটা হয় প্রায় তিন দশক আগে। সেই বিতর্কের অবসান হয়েছিল
১৯৯৬ সালে। ক্ষমতাশীন দল বিএনপি প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে
ইলেকশন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপরের ২০০৮-০৯ এর সেই লেজেন্ডারি ঘটনা তো ভিডিওর
শুরুতেই বললাম। সেই ভয়েই ২০১১ সালে আওয়ামী লিগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ব্যবস্থা বাদ দিয়ে দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লিগ ছিল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীদার। তখন বিএনপি মানতে চায় নি। এখন হচ্ছে ঠিক তার উল্টো।
বিএনপি দাবী করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেওয়ার জন্যে। কিন্তু আওয়ামী লিগ মানছে না। মজার
ব্যাপার হচ্ছে, ২০১১ তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেওয়ার আগে পর্যন্ত কোনো
নির্বাচনেই কোনো পলিটিকাল পার্টি টানা দুইবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে পারে নাই।
এবার দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক
সরকার আসলে কাদেরকে নিয়ে তৈরি হয়? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে বলা হত প্রধান উপদেষ্টা।
মূলত অবসর নেওয়া সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিই হতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান
উপদেষ্টা, যে পোস্ট ছিলো প্রধানমন্ত্রীর সমান। তিনি ১০ জন নিউট্রাল ব্যক্তিদের
উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতেন। যারা হতেন মন্ত্রীদের সমান। তারাই তিন মাসের জন্য
রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন, নির্বাচন আয়োজন করতেন এবং নতুন
নির্বাচিত হওয়া রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা ছাড়তেন।
বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ছিল এরশাদ আমলের পরে ১৯৯০-৯১ সালে, যার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সেই সময়কার
প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেই যে সব
সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু না। বিএনপি একবার বিচারকদের অবসরের সময়সীমা ৬৫
থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করে। যার পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের পছন্দ মতো প্রধান
উপদেষ্টা ঠিক করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ম্যানিপুলেট করা। মোট কথা, যে কোনো
ব্যাপারে স্বচ্ছতা বাংলাদেশের মানুষদের জন্য একটি বিলাসিতার নাম। কারণ দিনশেষে
জনগণের মধ্য থেকেই তো পলিটিকাল ফিগার উঠে আসে। দেশের সাধারণ মানুষ মাসুদ হয়ে বসে
থাকলে তো আর কিছু করার নেই।