মাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলার ক্রিকেটের এক উজ্জল নহ্মত্র। হামাগুড়ি দিতে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তার হাত ধরেই উঠে দাঁড়িয়েছে। ধারাবাহিকভাবে জিততে শিখেছে। আইসিসির কোন ট্যুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমি ফাইনালও খেলেছে টাইগাররা তার হাত ধরে। মাশরাফি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা পেস বোলার তো বটেই, সেরা অধিনায়কও।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়তোবা অনেক নক্ষত্র আসবে যাবে, অনেক বড় অর্জন আসবে। কিন্তু দুটো ব্যাপার হয়তো কখনো আসবে না। একটি হচ্ছে সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার, অন্যটি মাশরাফির মতো একজন লিডার।
ম্যাশের ডেবিউ হয় টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপহ্মে এম এ আজিজ স্টোডিয়ামে। আন্ডার নাইন্টিন দলে থাকা অবস্থায় নজড়ে পড়েন অ্যান্ডি রবার্টসের। সেই সময় অ্যান্ডি রবার্টস ছিলেন বাংলাদেশ দলের অস্থায়ী বোলিং কোচ। তারই পরামর্শে জাতীয় দলে জায়গা পান "নড়াইল এক্সপ্রেস"। অভিষেক ম্যাচেই তিনি তার জাত চিনিয়ে দেন। অভিষেক ম্যাচে তিনি ১০৬ রানে ৪ উইকেট নেন। কিন্তু নিজের তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপহ্মে খেলতে নেমে হাটুতে আঘাত পান। এরপর প্রায় দুই বছর তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়।
এরপর ২০০৪ এ ভারতের সাথে প্রথম জয়, ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো, সেই বছরই ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ড্রসহ আরো বেশি কিছু ম্যাচের নায়ক ছিলেন মাশরাফি। কিন্তু এরপর ২০০৯ থেকে ২০১১, এই দুই বছর ছিল ম্যাশের জীবনের সবথেকে বাজে সময়।
২০০৯তে উইন্ডিজ সফরে পাওয়া চোট ও ২০১০-এ পাওয়া চোটের কারণে মাশরাফি প্রায় মাঠ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। প্রায় দেড় বছর খেলা থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও তিনি দলের সেরা বোলার ছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপ সামনে রেখে নিজেকে তৈরি করেছিলেন, এমনকি ফিটনেসেও যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। কিন্তু ফিটনেসের দোহাই দিয়ে তৎকালীন টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচক কমিটি মাশরাফিকে বাদ দিয়ে দেয়। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার বেদনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। দেশবাসী সে প্রমাণ পেয়েছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়, অঝোরে কেঁদেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন আজ।’
এরপরে সারা দেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়, মাশরাফিকে বিশ্বকাপ দলে নেয়ার জন্য সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদ দেখা যায়।
‘২০১১ বিশ্বকাপে মাশরাফির বাদ পড়া’ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হয়ে থাকবে, কারণ সারা দেশের মানুষের চাওয়া ছিল মাশরাফি স্কোয়াডে থাকুন। গুঞ্জন ছিল, বোর্ডকর্তা ও কোচের সাথে দূরত্বের কারণে তিনি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পাননি। ২০১২ সালে মাশরাফিকে বোর্ড আবার জাতীয় দলে ফেরান অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজে। ২০১২-১৪ বাংলাদেশের ক্রিকেট খুবই বাজে সময় অতিবাহিত করে, বিসিবি ক্রিকেট দলের টালমাটাল অবস্থা ঠিক করতে মাশরাফির হাতে অধিনায়কত্বের ব্যাটন তুলে দেয় ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে। এরপর থেকেই তার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার গল্পের শুরু।
এ সিরিজের মধ্য দিয়ে যেন বাংলাদেশ দলে নতুন এক প্রাণ সঞ্চার হয়। জিম্বাবুয়েকে ৫-০তে ‘বাংলাওয়াশ’ করে মাশরাফি তার প্রথম হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করেন শতভাগ সফলতার মাধ্যমে। এরপরের গল্প বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানের, যার নেতৃত্বে মাশরাফি নামক দক্ষ নাবিক। দলের সবার মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার, মাঠে ও ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের উজ্জীবিত করে সবার মধ্যে ভয়ডরহীন মানসিকতা এনে বাংলাদেশ দলের খোলনলচে বদলে দেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করে মাশরাফির নেতৃত্বে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার সাথে সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েও বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় মাশরাফির ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে; যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সেরা অর্জন। এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মাঠে পারফরম্যান্স আগের সব ইতিহাসকে ছাপিয়ে যায়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচের কথা বলতে হয়।
মাহমুদউল্লাহর অসাধারণ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ২৭৫ রান সংগ্রহ করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ইংল্যান্ড জিতে যাবে সহজে। কিন্তু মাশরাফি হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। বোলিংয়ে এসে বাংলাদেশকে পরম আরাধ্য ব্রেক থ্রু এনে দেন হেলসকে আউট করে। এরপর বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড চেঞ্জে অসামান্য পারদর্শিতার স্বাক্ষর রাখেন পুরো ম্যাচে। ম্যাচের ক্রুশিয়াল মোমেন্টে জো রুটকে আউট করে বাংলাদেশের জয় প্রায় নিশ্চিত করে দেন। এরপর রুবেলের অসাধারণ বোলিং এবং বাংলাদেশের ইংল্যান্ড বধ!
নিউ জিল্যান্ডের সাথে প্রায় তো জিতেই যাচ্ছিল বাংলাদেশ। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের সাথে বিতর্কিত আম্পায়ারিং না হলে হয়তো বা বাংলাদেশ আরো বড় কিছু অর্জন করতো ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরপরই বাংলাদেশে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে। মাশরাফির চমকপ্রদ নেতৃত্বে ও মুস্তাফিজে ভর করে বাংলাদেশ অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়ে টানা দুই সিরিজে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারিয়ে দেয়। এরপর মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকেও ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে।
এরপরও অব্যাহত থাকে বাংলাদেশের জয়যাত্রা, যার জ্বলন্ত প্রমাণ ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। গ্রুপ স্টেজে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এটা আইসিসির যেকোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জন। এছাড়া বাংলাদেশ মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে রানারআপ হয়। শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে প্রথম অ্যাওয়ে সিরিজ জয়ও মাশরাফির নেতৃত্বে। ছয়টি বিপিএল আসরের মধ্যে চারবার মাশরাফি শিরোপা জিতেন অধিনায়ক হিসেবে। বাংলাদেশ আইসিসি ওডিআই র্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবারের মতো ৬ নম্বরে উঠেছিল তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে। ক্যাপ্টেন হিসেবে মাশরাফির সবশেষ সিরিজ জিম্বাবুয়ের সাথে ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে, এবং শেষটাও শুরুর মতো জিম্বাবুয়েকে ৩-০তে বাংলাওয়াশ করার মাধ্যমে।
শেষ ম্যাচ জেতার মাধ্যমে তিনি অধিনায়ক হিসেবে ৫০ ওয়ানডে জয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেন মাত্র ৮৮ ম্যাচে। উইনিং পার্সেন্টেজ প্রায় ৫৭ পারসেন্ট। যেই দিক দিয়ে মাশরাফি মহেন্দ্র সিং ধোনি, ইমরান খান, অর্জুনা রানাতুঙ্গা এবং সৌরভ গাঙ্গুলীর চেয়েও এগিয়ে। এসব অর্জন হয়তো মাশরাফির বিশালতা প্রকাশ করতে পারবে না। মাশরাফি যুগের সবচেয়ে বড় অর্জন, মাশরাফি এক সুতোয় সবাইকে বেঁধে বাংলাদেশকে মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রফেশনালিজম শিখিয়েছেন। মাশরাফির সবচেয়ে বড় অর্জন, বাংলাদেশ এখন আর কোনো ম্যাচ জয়ের জন্য একজনের উপর নির্ভরশীল থাকে না, সবাই অবদান রাখতে চায় বাংলাদেশের জয়ে।
মুদ্রার অপর পিঠের দেখাও প্রচুর পেয়েছেন মাশরাফি তার ক্যারিয়ারে। যার অনেকটা জুড়েই আছে ইঞ্জুরি। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার ইনজুরিতে পড়েছেন মাশরাফি, যার মধ্যে বাঁ হাঁটুতে চারবার এবং ডান হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে তিনবার।
ক্যারিয়ারের শুরুতে ১৪০ কিমি গতির আশেপাশে বল করতেন, কিন্তু ইনজুরির কাছে তার মানসিকতা জয়ী হলেও গতিবেগ হার মানে। স্পোর্টসের ইতিহাসে মাশরাফির মতো এমন স্পোর্টসম্যান খুবই রেয়ার, যিনি বারবার ইনজুরিতে পড়েও মাঠে ফিরে এসেছেন সদর্পে, এবং ম্যাচ জিতিয়েছেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার রেশ ধরে ছেড়ে দেন অধিনায়কত্ব। অবসর নিতেও বলে দেয় বিসিবি। কিন্তু ম্যাশ রাজি হন না। এরপরেই দল থেকে বাদ পড়েন। শেষটা ভালো না হলেও, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এত কিছু দেওয়ার জন্যে দেশের সত্যিকারের ক্রিকেট ভক্তরা সবসময় মনে রাখবে ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক মাশরাফিকে।
মাশরাফির মতো আর কাউকে কি বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনো পাবে? কি মনে হয় আপনাদের?