বিভিন্ন স্পোর্টসে বিভিন্ন খেলোয়াড় কিংবা ক্লাবেরই প্রিয় গ্রাউন্ড রয়েছে। বিরাট কোহলি যেমন ভালোবাসেন অ্যাডিলেইডকে। রিয়াল মাদ্রিদের আবার নিজেদের মাঠ সান্টিয়াগো বার্নাব্যুতে খেললে যেন শক্তিমত্তা কয়েকগুণ বেঁড়ে যায়! লিভারপুলেরও তাই, অ্যানফিল্ড যেন প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমত দুর্গ। তেমনি টেনিস তারকা রাফায়েল নাদাল হচ্ছে ক্লে কোর্ট কিংবা রোলা গাঁরোর রাজা।
ফ্রেঞ্চ ওপেনের ক্লে কোর্টে নাদালের রেকর্ড রীতিমত দুর্ধর্ষ। ১৮ বার খেলে শিরোপা জিতেছেন ১৪ বার! ১১৫ ম্যাচে হেরেছেন মোটে ৩ বার। অবিশ্বাস্য রেকর্ড। নাদালের টেনিসে আগমন তার চাচার হাত ধরে। তার চাচাও ছিলেন টেনিস প্লেয়ার। ১৫ বছর বয়সে প্রোফেশনাল টেনিসে পা রাখেন নাদাল। সেই থেকে শুরু, যা বর্তমানে ৩৭ বছর বয়সেও চলছে। ‘দ্য স্প্যানিশ বুল’-খ্যাত এই তারকা ২২ বছরের পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ারে এখন অবধি জিতেছেন ৯২টি শিরোপা। পুরুষ এককের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ডটিও তার নামের পাশে। তার ২২ টি গ্র্যান্ড স্লামের থেকে বেশি আছে শুধু নোভাক জোকোভিচের। তিনি একটি বেশি জিতেছেন।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এছাড়াও ৩৬টি মাস্টার্স শিরোপার পাশাপাশি স্পেনের হয়ে বেইজিং
অলিম্পিকে স্বর্ণপদকও জিতেছেন তিনি। আন্দ্রে আগাসির পরে মাত্র দ্বিতীয় টেনিস প্লেয়ার
হিসেবে ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন নাদাল। নিজের ক্যারিয়ারকে যেমনভাবে তুলেছেন
শীর্ষ পর্যায়ে, তেমনই নিজের দেশের পতাকাকেও তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের মাঝে। যার কারণে
স্পেনের ছেলে-বুড়ো সবার নিকট দেশটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবেও
পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
স্পেনের মায়োর্কার ম্যানাকোরে সেবাস্তিয়ান নাদাল ও আনা মারিয়া
প্যারেরা দম্পতির ঘরে ১৯৮৬ সালের ৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নাদালের বাবা একজন সফল
ব্যবসায়ী, তার একমাত্র ছোট বোনের নাম মারিয়া ইসাবেল নাদাল। ছোটবেলায় নাদালের বেশিরভাগ
সময় কেটেছে তার দুই চাচার সঙ্গে, কারণ তারা দুজনেই প্রোফেশনাল স্পোর্টসম্যান ছিলেন।
মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল নাদাল ছিলেন একজন ফুটবলার এবং টনি নাদাল ছিলেন একজন প্রোফেশনাল টেনিস
খেলোয়াড়।
মূলত চাচা টনি নাদালের হাত ধরে মাত্র ৩ বছর বয়সেই টেনিস র্যাকেট
হাতে নেন রাফা। ডানহাতি হওয়ার পরও টনি তাকে বাঁহাতে টেনিস খেলায় পারদর্শী করে তোলেন।
অন্যদিকে, মিগুয়েল নাদালের কাছ থেকে নাদাল ফুটবলের প্রশিক্ষণও নিতেন। যার ফলে খুব অল্প
বয়সে ফুটবল এবং টেনিস দুটোকেই রপ্ত করেন রাফা। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি টেনিসকে বেছে নিয়েছিলেন
নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে।
রাফায়েল নাদাল ছোটবেলায় টেনিস প্রশিক্ষণের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন
ক্লে কার্টে, যার প্রভাব তার পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ারে খুব ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।
১৯৯৪ সালে ১২ জন প্রতিযোগীর একটি টেনিস টুর্নামেন্টে অংশ নেন রাফা। সেখানে শিরোপা জেতায়
স্থানীয়রা তার প্রশংসা করেন। অতঃপর ১২ বছর বয়সে নাদাল বয়সভিত্তিক টেনিস টুর্নামেন্টে
অংশগ্রহণ শুরু করেন এবং শিরোপা জেতেন।
তবে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বেশিদিন ঘাম ঝরাতে হয়নি তাকে।
টনি নাদালের সহযোগিতায় এবং নিজের কঠোর পরিশ্রমের কল্যাণে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পেশাদার
টেনিসে নাম লেখান রাফা।
পেশাদার টেনিসে অভিষেকের এক বছর পরই নাদাল মায়ামি মাস্টার্সে
রজার ফেদেরারকে হারিয়ে টেনিসবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। সেই সময়ে ডেভিস কাপে অ্যান্ডি
রডিককে হারিয়ে শিরোপাও জিতে নেন।
তবে তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০০৫ সাল। ঐ বছরই প্রথমবারের
মতো ফ্রেঞ্চ ওপেনের দ্বারা গ্র্যান্ড স্লাম জিতেন তিনি। একই বছর বার্সেলোনা ওপেন, রোম
ওপেনের মতো মাস্টার্স শিরোপাও জেতেন তিনি। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো র্যাংকিং এ তিন
নম্বরে উঠে আসেন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। টেনিসে স্থায়ীভাবে লিখিয়ে
নিয়েছেন নিজের নাম। ২২ গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে ১৪ টিই জিতেছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে। ইউএস
ওপেন জিতেছেন ৪ টি। এবং ওয়েম্বলডন ও অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন দুটি করে। এছাড়াও আরো
৮ বার হয়েছেন রানার্স-আপ। এর মধ্যে ফাইনালে জোকোভিচের কাছে হেরেছেন ৪ বার এবং ফেদেরারের
কাছে হেরেছেন তিনবার। এছাড়াও অলিম্পিকে সিঙ্গেল এবং ডাবলস মিলিয়ে জিতেছেন দুটো স্বর্ণপদকও।
একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নাদাল যেমন সফল, তেমনই একজন সমাজসেবী
হিসেবেও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ২০০৭ সালে রাফায়েল নাদাল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি
তার সেবামূলক কার্যক্রম শুরু করেন। তার সংস্থাটি মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে
কাজ করে। নাদাল তার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও অনন্তপুরে সহযোগিতার
হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার নিজের শহরের শিশু-কিশোরদের নিয়ে স্থায়ীভাবে
কাজ শুরু করেন।
জলবায়ুর পরিবর্তনে বিশ্বাবাসীকে সচেতন করার একটি কার্যক্রমেও
অংশ নিয়েছিলেন নাদাল। তিনি তার ফাউন্ডেশন থেকে অর্থের যোগান দিয়ে কয়েকটি দেশে বৃক্ষরোপণ
কর্মসূচি পরিচালনা করেন। বর্তমান সময়ে অবশ্য টেনিস ছাড়াও গলফ, ফুটবল ও ব্যবসায়ে যথেষ্ট
সময় দিচ্ছেন নাদাল।
নাদালের আয়ের বেশিরভাগ আসে টেনিসের প্রাইজমানি থেকে। তিনি টেনিস
হিস্টোরির থার্ড রিচেস্ট প্লেয়ার। এছাড়াও তার টেনিস একাডেমি, হসপিটাল এবং মোনাকোতে
রিসোর্ট ব্যবসা রয়েছে।
নাদাল স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের একজন ডাই হার্ড ফ্যান।
ভবিষ্যতে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নও দেখেন। ধারণা করা হয়, বর্তমানে তিনি রিয়াল
মাদ্রিদ বোর্ডের সাথেও সম্পৃক্ত আছেন।
লাস্ট কয়েক বছরে হাটুর ইঞ্জুরি বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। খেলা বেশ স্লো-ও হয়ে গেছে তার সেই কারণে। এই বছরেরও বেশিরভাগ সময় ধরেই আছেন কোর্টের বাইরে। তবে ২০২৪ এ ফিরবেন বলে জানিয়েছেন নাদাল নিজেই। নাদাল কি পারবে, ফেদেরার ও জোকোভিচকে সব দিক দিয়ে ছাড়িয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে?