ফেসবুকের শুরুর দিকে একটা মতবাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। দুই বন্ধুর আড্ডায় এক বন্ধু হঠাৎ বললো ও কখনো প্লেনে করে কোথাও যাবে না। অন্য বন্ধু তখন জিজ্ঞেস করলো কেন? প্রথমজন তখন বললো, দেখ সরাসরি মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারবো, কিন্তু ধর সেদিন পাইলটের কপালেই মৃত্যু লেখা আছে। অত্যন্ত বাজে যুক্তি হলেও এরকম অনেকেই আছেন যারা প্লেনে কিংবা জাহাজে চড়তে ভয় পায়। আকাশপথ ও পানিপথ অনেকের কাছেই নিরাপদ মনে হয় না। যে কোনো সময়ে মৃত্যুর হাতছানি থাকে। সেই তুলনায় ট্রেন জার্নিকে বেশিরভাগ মানুষই নিরাপদ মনে করে। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা আছে, যেগুলো সম্পর্কে জানলে নেক্সট টাইম ট্রেন জার্নি করতেও আত্মা কেঁপে উঠবে আপনার।
নাম্বার টেন – ইতালির ট্রেন দুর্ঘটনা
২০১৬ সালে ইতালিতে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সেই দুর্ঘটনায় মোট ২৫ জন মারা যায়। আহত হয় আরও অন্তত ৫০ জন। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই ওই দুর্ঘটনায় তিনটি বগি লাইন থেকে আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ে। পুগলিয়া অঞ্চলের কোরাটো এবং আন্দ্রিয়া নামক ছোট দুটি শহরের কানেক্টেড ট্রেন লাইনে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
নাম্বার নাইন – মিশরের ট্রেন
দুর্ঘটনা
২০১৯ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি মিশরের কায়রোতে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে। কায়রোর প্রধান
ট্রেন স্টেশনে দুর্ঘটনার পরে আগুন লেগে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়। ট্রেনটি স্টপেজ পার করে
গিয়ে স্টিলের ব্যারিকেডের সাথে ধাক্কা লাগে। সাথে সাথে বিকট শব্দ করে আগুন ধরে যায়।
এতে অন্তত ২৫ জন মারা যায়। এবং ৫০ জনের মতো মারাত্মকভাবে আহত হন।
নাম্বার এইট – তাইওয়ানের ট্রেন
দুর্ঘটনা
তাইওয়ানে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর ভয়াবহ এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। তাইওয়ানের
ইয়েলান শহরে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রেনটিতে মোট ৩৬৬ জন যাত্রী ছিল। ট্রেনটি মূলত লাইন ব্রেক
করে একটি ট্যুরিস্ট জোনে ঢুকে যায়। এরপর ট্রেনের ৪টি বগি উল্টে যায়। এতে প্রায় ২২ জন
ভিক্টিম মারা যায়। গুরুতর আহত হয় ১৭১ জন।
নাম্বার সেভেন – হিলি ট্রেন ট্র্যাজেডি
১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি। রাত তখন প্রায় সোয়া ৯টা। বাংলাদেশের গোয়ালন্দ থেকে
পার্বতীপুরের ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়।
এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনার ৭৪৮ নম্বর ইন্টারসিটি সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি
একই লাইনে ঢুকে পড়ে। দুই ট্রেনের মুখোমুখি ধাক্কায় মারাত্মক এক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে।
গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ দুটি বগি দুমড়েমুচড়ে সীমান্ত এক্সপ্রেসের উপরে উঠে
যায়। এই দুর্ঘটনায় দুই ট্রেন মিলিয়ে প্রায় ৫০ জন প্যাসেঞ্জার মারা যায়। ইঞ্জুর্ড হন
প্রায় দুইশ জন।
নাম্বার সিক্স – ওয়েস্ট বেঙ্গল
ট্রেন ট্র্যাজেডি
এই অ্যাক্সিডেন্টের টাইমলাইনটি ঠিক জানা যায় নি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের
গাইসালে দাঁড়িয়েছিল ব্রহ্মপুত্র মেইল ট্রেন। সেই সেইম লাইনে আসাম এক্সপ্রেস ট্রেনটি
ফুল স্পিডে এসে তাকে ধাক্কা দেয়। এতে ২৮৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ইঞ্জুর্ড হন
প্রায় ৩০০ মানুষ। যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য।
নাম্বার ফাইভ – মেক্সিকোর ভয়ানক ট্রেন দূর্ঘটনা
জানুয়ারী মাসের শীতের
দিন ছিল, সালটা ১৯১৫। ট্রেনটি প্রায় ৯০০ জন যাত্রী নিয়ে একটি খারা ঢালের মধ্য দিয়ে
নামছিল। ট্রেনের চালক ব্রেকটা ধরেই রেখেছিলেন। কিন্তু হুট করেই ট্রেনটির ব্রেক ফেইল
ঘটে। খাড়া ঢাল থাকার কারণে, ট্রেনটির গতিও বেড়ে যায়। ট্রেনটি লাইন থেকে আলাদা হয়ে
যায়, এবং ‘গুয়াদালাজারা’র কাছে একটি গিরিখাতে গিয়ে পড়ে। ট্রেন থেকে অনেক যাত্রী ছিটকে
পড়ে যায়, এবং অনেকেই মারা যান। এই দুর্ঘটনায় প্রায় ৬০০ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল।
নাম্বার ফোর – রাশিয়ার উফা ট্রেন দূর্ঘটনা
জুন,
১৯৮৯। সেই সময়েই রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর
মধ্যে একটি ঘটে। রেল-লাইনের পাশেই ছিল একটি গ্যাস পাইপলাইন। সময় ভোর ১ টা ১৫ মিনিট।
এই সময় পাইপলাইনে গ্যাস লিক করে এবং আগুন লেগে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে। ঠিক এই সময় দুটি
প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্রায় ১৩০০ জন যাত্রী নিয়ে একে অপরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনের
যাত্রীদের মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব, আবার অনেকেই ঘুমিয়ে রয়েছেন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে হতচকিত
হয়ে যান কিছু যাত্রী। কিছু বোঝার আগেই বিস্ফোরণের তিব্রতায় ঝাঁঝরা হয়ে যায় অনেক
যাত্রী। হসপিটাল এবং ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় প্রায় ৫৭৫ জন যাত্রীর। ৮০০ এরও বেশি যাত্রী
গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
কিন্তু বেসরকারি মতে, মৃতের
সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৮০ জন। এবং এদের মধ্যে ১৮১ জন ছিল শিশু। যারা বেঁচেছিল তাদের মধ্যে
অনেকেই পরবর্তীতে ব্রেনের সমস্যা এবং পুড়ে যাওয়া অঙ্গ নিয়ে জীবন-যাপন করেছিলেন।
নাম্বার থ্রি – ফ্রান্সের ভয়াবহ ট্রেন দূর্ঘটনা
এই ট্রেন দুর্ঘটনাটি এখনও পর্যন্ত ফ্রান্সের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। তবে এই ট্রেন দুর্ঘটনাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। প্রায় ১০০০ জন ফ্রেঞ্চ সৈন্য নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করেছিল। অতিরিক্ত পরিমাণ যাত্রী্র কারণে ট্রেনটিতে কিছু আলাদা বগি যোগ করা হয়। ফলে ট্রেনটির দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৩৫০ মিটার। সব মিলিয়ে ট্রেনটির ওজন দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫২৬ টন। বগি গুলির মধ্যে প্রথম তিনটি বগির জন্য এয়ার ব্রেক থাকলেও, বাকি বগি গুলির জন্য শুধুমাত্র হ্যান্ড ব্রেক ছিল। যার ফলে এটি খুবই বিপদজনক একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেইদিকে পরোয়া না করেই জুড়ে দেওয়া হয় অতিরিক্ত ১৯ টি বগি।
উপত্যকা থেকে নিচে নামার সময় ট্রেন চালক যতটা আস্তে সম্ভব ততটা আস্তেই ট্রেনটিকে নামাচ্ছিলেন। এইসময় ট্রেনটির গতি ছিল ঘন্টায় মাত্র ১০ কিলোমিটার। কিন্তু কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎই ট্রেনটির গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে। চালক ব্রেক কষলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ ট্রেনটির ভার অতিরিক্ত বেশি ছিল, যার ফলে উঁচু জায়গা ক্রস করার সময় পেছনের বগিগুলি ইঞ্জিনকে সামনের দিকে ধাক্কা দিচ্ছিলো। অ্যাজ আ রেজাল্ট ট্রেনটি লাইন থেকে পড়ে যায়। এই সময় ট্রেনটির গতি ছিল ঘন্টায় প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। ট্রেনটির বগিগুলি তৈরিতে কাঠের ব্যবহার বেশি ছিল। আবার অন্যদিকে ব্রেকগুলি অতিরিক্ত চাপে খুবই গরম হয়ে গিয়েছিল। তার উপর সৈন্যদের সাথে ছিল মোমবাতি ও গ্র্যানেড। ফলে ট্রেনটিতে ভয়াবহ আগুন লেগে যায়। দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় প্রায় ৬৭৫ জনের। ১৩৫ জনের দেহ এত খারাপ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, যে তাদের ঠিকমত শনাক্ত করাও সম্ভব হয়ে উঠেনি।
নাম্বার টু – বিহারের ট্রেন দূর্ঘটনা
১৯৮১ সালের জুন মাসের ঘটনা, প্রতিদিনের মতো ‘মান্সি’ এবং ‘সাহারাসা’ ষ্টেশনের মধ্যে প্রায় ১০০০ জন যাত্রী নিয়ে নিজের গন্তব্যে যাচ্ছিল প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি। সকাল থেকেই আবহাওয়া ছিলো বেশ খারাপ। প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি সবেমাত্র ‘বাগমতী’ নদীর রেল ব্রিজের উপর উঠেছিল। তাদের কপাল এতটাই খারাপ ছিল যে, ঠিক সেই সময়েই ধেয়ে আসে প্রকাণ্ড এক ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ে ট্রেনটি লাইন থেকে বাগমতী নদীতে পড়ে যায়। উদ্ধারকারী টিম এসে ৫ দিনে মাত্র ২০০ জন যাত্রীর মৃত দেহ উদ্ধার করতে পেরেছিল। বাকিরা বাগমতী নদীর পানির সাথেই ভেসে যান। ধারণা করা হয়, এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ জন মানুষ।
নাম্বার ওয়ান – শ্রীলঙ্কার
ট্রেন দূর্ঘটনা
পৃথিবীর
ইতিহাসে সবথেকে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ধরা হয়, শ্রীলঙ্কার ২০০৪ সালে সুনামির সময়
ঘটে যাওয়া “কুইন অফ দ্যা সী” নামক দুর্ঘটনাকে। এই ট্রেনটি শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো
এবং মাতারার মধ্যে যাতায়াত করত। যাত্রাপথে পড়ে ভারত মহাসাগর।
২০০৪
এর ২৬ ডিসেম্বর প্রায় ১৮০০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি ‘কলম্বো’ থেকে যাত্রা শুরু করে।
‘পেরালিয়া’ গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনে থাকা যাত্রীরা সমুদ্রের উপকূল
থেকে দানবাকৃতি একটি ঢেউ তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঢেউটি ট্রেনের
বগিগুলির উপর আছড়ে পড়ে। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। এর
পরের ঢেউটি সব শেষ করে দেয়। বিশালাকৃতির এই ট্রেনটিকে এক ধাক্কায় লাইন থেকে ছিটকে ফেলে দেয়।
সেই দুর্ঘটনায় সার্ভাইভ
করেছিল মাত্র ১৫০ জন। ডেডবডি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৭০০ জনের।