সাধারণত মিশরে অবস্থিত প্রাচীন ইজিপশিয়ান রাজা বা ফারাওদের
সমাধিক্ষেত্রকে পিরামিড বলা হয়। এ সমাধিক্ষেত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো,
সাধারণভাবে এ সমাধিগুলো মাটি খুড়ে বা ছোট মিনার গড়ে তৈরি করা হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে
বিরাট পিরামিড আকারে। এই পিরামিডের ভেতরে সমাহিত করা হতো রাজা, রাণীকে। রাজারা
তাদের জীবৎকালেই তৈরি করতেন একেকটি পিরামিড। এই পিরামিডগুলোর মধ্যে ফারাও খুফুর
পিরামিডটিই সর্ববৃহৎ। এ পিরামিডটি গ্রেট পিরামিড অফ গিজা নামে পরিচিত। যাই হোক,
পিরামিড সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট স্থাপত্যের একটি। তাই এটিকে
ঘিরে রয়েছে অনেক রহস্যময় ও বিষ্ময়কর তথ্য।
১. দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাজটেক, মায়া সভ্যতা অর্থাৎ বর্তমান সময়ের পেরু, মেক্সিকোসহ অন্য অঞ্চলেও পিরামিড দেখা যায়। তবে মিশরীয় সভ্যতার পিরামিড বিখ্যাত। এর পেছনে কারণ হচ্ছে এগুলো যেমন সংখ্যায় অনেক বেশি, তেমনি গুণগত মান এবং হিস্টোরিকাল ভ্যালুও অনেক বেশি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মিশরে ১৩৮ টি পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে।
২. মজার ব্যাপার হলো পিরামিডের জন্য মিশর সবথেকে বিখ্যাত হলেও
সর্বোচ্চ সংখ্যক পিরামিডের দেশ কিন্তু মিশর না। মিশরের প্রায় দ্বিগুণ পিরামিড আছে
আফ্রিকারই আরেক দেশ সুদানে। এখনো পর্যন্ত ২৫৫ টি পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে সুদানে।
৩. পিরামিডের কথা উঠলেই আমাদের সামনে মিশরের ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু এখন
পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া পিরামিডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটা কিন্তু মিশরে নয়, রয়েছে
ইন্দোনেশিয়ার জাভা প্রদেশে। গুনাং পেডাং নামে প্রায় মাটির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া এই
পিরামিডটি যে সবচেয়ে পুরোনো পিরামিড এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু
হাল আমলের আধুনিক জিও ইলেকট্রিক এবং জিও ম্যাগনেটিক পরীক্ষায় এই পিরামিডের প্রায়
৫০ ফুট গভীরে একটি বিশাল কক্ষের খোজ পেয়েছেন গবেষকরা। এছাড়া আগ্নেয়শিলা কেটে
বানানো পাথরের বিশাল বিশাল খন্ডগুলোর পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা জানান তা
খ্রিস্ট্রেরও জন্মের ৭ হাজার বছর আগে তৈরি করা হয়েছিলো। আবার অনেকের মতে এই
পিরামিডটি ২০ হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিলো।
৪. মিশরের পিরামিড যেখানে অবস্থিত সেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত গরম এবং
সবসময় গরম বাতাস চলতে থাকে। এতো কিছুর পরও পিরামিডকে এমন এক আশ্চার্য উপায়ে
বানানো হয়েছে যে এর ভিতরে সবসময় ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বজায় থাকে। যা
পৃথিবীর সবচেয়ে আরামদায়ক তাপমাত্রা।
৫. মিশরীয় পিরামিডগুলোর আরেকটি রহস্য হচ্ছে এর ভেতরে নির্মিত টানেল বা সুরঙ্গ পথ। এসব পিরামিডের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সুরঙ্গ পথ। আদৌ কেন এই সুরঙ্গপথগুলো তৈরি করা হয়েছিলো তার সঠিক উত্তর আজ পর্যন্ত কেউই দিতে পারে নি। প্রথমদিকে বিশ্বাস করা হতো পিরামিডের ভেতরের সুরঙ্গ পথগুলো মূলত পিরামিডে ভেন্টিলেশনের জন্য হয়তো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে উৎসুক প্রত্মতাত্বিকরা যখন একটি রোবটকে পিরামিডের ভেতরে পাঠালেন তখন এই তথ্যটিও ভুল প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ পিরামিডগুলোর ভেতরে যে সুরঙ্গ পথ তা কোনো ধরনের ভেন্টিলেশনের জন্য তৈরি করা হয়নি। কেননা এই সুরঙ্গ পথগুলো কংক্রিট দিয়ে বিপরীত বন্ধ করা ছিলো। তাহলে কিসের জন্য তৈরি করা হয়েছে এসব সুরঙ্গ পথ?
মিশরের পিরামিডগুলোর
ভেতরে কতগুলো সুরঙ্গ পথ বা চেম্বার আছে কেউ সঠিক করে বলতে পারে নি। তবে এ নিয়ে
যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন তারা কিছু বিশেষ চেম্বারকে আলাদা করেছেন। যেগুলো
হলো- কিংস চেম্বার, কুইন্স চেম্বার, বেইজ চেম্বার, বিগ ভয়েড, স্মল ভয়েড এবং
গ্র্যাণ্ড গেলারি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা পিরামিডের ভেতরে থাকা অনেকগুলো চেম্বারের
মধ্যে এই চেম্বারগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি।
পিরামিডের ভেতরের কিংস
চেম্বারে মিশরীয়রা মৃত রাজাকে রাখতো। তারা বিশ্বাস করতো কিংস চেম্বারে মৃত রাজাকে
রাখলে তার আত্মা খুব সহজেই আকাশের ওই তিনটি তারার সাথে মিলিত হতে পারবে। ধারনা করা হয় এই
পিরামিডের ভেতরে আরো অসংখ্য চেম্বার রয়েছে। যা এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
৬. অনেক দিন ধরেই মানুষের
মধ্যে একটা ধারনা ছিলো পিরামিড বানানোর কাজে ফারাওরা দাসদের ব্যবহার করতেন। অবশ্য
পিরামিডের ইতিহাস ঘাটলে এমন একটা ধারনা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি বলা হয় সাধারণ
দাসদের পক্ষে এত নিখুঁতভাবে পিরামিড তৈরি করা সম্ভব হলো কিভাবে? তাহলে সে প্রশ্নের
উত্তর পাওয়া যায় না। এদিকে, ১৯৯০ সালে পিরামিডের পাশে একটি দেয়াল আবিষ্কার করা হয়।
পরে জানা যায় সেটা আসলে একটি কবর। দেয়ালে লেখা হায়ারোগ্লিফিকের মানে উদ্ধার করে
জানা যায় কবরে শায়িত ব্যক্তিটি পিরামিড নির্মাণের এক দক্ষ শ্রমিক ছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, পিরামিডের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনার পাশে
একজন সাধারণ নির্মাণ শ্রমিককে কবর দেয়া হয়েছিলো কেন। এরপর অনেকেই মত দেন, পিরামিড
তৈরির জন্য সমগ্র মিশর থেকেই দক্ষ শ্রমিকরা আসতেন। আর কাজ করতে গিয়ে কারো মৃত্যু
হলে সম্মান দেখিয়ে তাকে ফারাওয়ের পাশেই কবর দেয়া হতো।
৭. আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে গিজার
গ্রেট পিরামিডের চূড়ায় একসময় একটা সমতল চূড়ার ত্রিকোণাকার মূল্যবান পাথর বসানো
ছিলো। যা কোনো একসময় চুরি হয়ে গিয়েছে বলে মিশরীয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এক
স্প্যানিশ গবেষকের মতে ওই পিরামিডের চূড়ায় একটি গোলক বসানো ছিলো যা হোরাসের চোখ
নামে পরিচিত ছিলো। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে এই চোখ বিপদ থেকে রক্ষা, রাজকীয় ক্ষমতা
এবং ভালো স্বাস্থ্যের প্রতিক ছিলো। তার মতে গিজার এই পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিলো
সূর্য এবং আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধকের পূজা করার জন্য। লুব্ধক তারাটি
ছিলো মিশরিয়দের দেবী আইসিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এই পিরামিডের চুরি হয়ে
যাওয়া শীর্ষটি খুঁজে না পাওয়া গেলে হয়তো কখনোই জানা যাবে না, কি রহস্য লুকিয়ে আছে
ওই হারিয়ে যাওয়া শীর্ষে।
৮. প্রাচীন মিশরে নির্মিত
সব পিরামিড নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। মিশরীয়দের ধারণা সূর্য পশ্চিমে মৃত
রাজাদের সম্মান জানিয়ে অস্ত যায়।
৯. বর্তমান পৃথিবীতে
বিভিন্ন স্থাপনা তৈরীতে যে ক্র্যান ব্যাবহার করা হয় তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা হচ্ছে
২০,০০০ কেজি। তাহলে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে প্রাচীন ইজিপ্টের লোকেরা কিভাবে
৭০,০০০ কেজির এই ব্লক গুলোকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়েছিল। তাদের কাছে
কি আরও উন্নত কোন প্রযুক্তি ছিল?
১০. পিরামিডগুলো তৈরীর
সময় বল এন্ড সকেট মেথড ব্যাবহার করা হয়েছিল। এটিএমন একটি মেথড যা গরমের সময়
ব্লকগুলোর আকার বৃদ্ধি পেয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। এই মেথড ভূমিকম্প প্রতিরোধ
করতে ব্যাবহার করা হয়। এ ধরণের পরিক্ষিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহার চার
হাজার বছর আগে, সত্যিই অবিশ্বাস্য।
১১. যে পাথর দিয়ে এই
পিরামিড বানানো হয়েছিল তা সাধারণ পাথরের চেয়ে লক্ষগুণ বেশি শক্তিশালী। এই পাথর
নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং বিজ্ঞানিরা আজ পর্যন্ত বের করতে পারেন নি যে এটা
আসলে কি। এটা লাইমস্টোনের মতো দেখতে হলেও এটি আসলে লাইমস্টোন নয় এবং এই পাথর
পৃথিবীর আর কোথাও খুজে পাওয়া যায়নি।
১২. পৃথিবীর
জিওগ্রাফিক্যাল মধ্যভাগে পিরামিডের অবস্থান। আজ থেকে চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর
মানুষ তো এটাই জানত না যে পৃথিবী গোলাকার। বরং তারা পৃথিবীকে সমতল মনে করত। তাহলে
তারা কিভাবে খুজে বের করতে পারল পৃথিবীর জিওগ্রাফিক্যাল মধ্যভাগ। এটা তখনকার
হিসেবে মানুষের দ্বারা আদৌ সম্ভব নয়।
১৩. পৃথিবীর অরিজিনাল সাত
আশ্চর্যের মধ্যে এখনো পর্যন্ত টিকে থাকা একমাত্র নিদর্শন এবং সবথেকে জনপ্রিয়
পিরামিড হচ্ছে মিশরের গিজার পিরামিড। যার উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি তৈরি করতে
সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল প্রায় এক লাখ।
১৪. উপযুক্ত কোন কারণ
জানা না থাকায় এখন পর্যন্ত মনে করা হয় যে, ওই সময়কার রাজা এবং রাণীর মৃতদেহকে
কবর দেয়ার জন্যেই এই পিরামিডগুলো বানানো হয়েছি। তখনকার সময় মৃতদেহ সংরক্ষনের
জন্যে মৃতদেহকে লাইনেনের সুতা দিয়ে পেঁচিয়ে মমি তৈরী করা হতো। তবে আশ্চার্যের
বিষয় এই যে এখন পর্যন্ত পিরামিডের ভিতর থেকে একটা মৃতদেহও পাওয়া যায় নি।