স্নায়ুযুদ্ধের সময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার কাছে মজুদ পারমাণবিক বোমার সংখ্যাই ছিল বর্তমান বিশ্বের মোট পারমাণবিক বোমার চেয়ে অনেক বেশি। সে সময় এই ২ দেশের কাছে ছিল প্রায় ৬৫ হাজার পারমাণবিক বোমা। আগে বোমা সংখ্যায় বেশি পরিমাণে থাকলেও খুব অল্প সংখ্যক দেশের কাছে তা ছিল। ৩০-৪০ বছর আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সংখ্যক দেশের কাছে পারমাণবিক বোমা আছে। আগে মোট বোমা সংখ্যা বেশি থাকলেও বর্তমানে দেশের সংখ্যা বেড়েছে এবং বর্তমান বিশ্বের মোট পারমাণবিক বোমার প্রায় ৯০ শতাংশ আছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি
গবেষণা ইন্সটিটিউট সিপ্রি-র তথ্য অনুসারে রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি
পারমাণবিক বোমা রয়েছে। দেশটিতে এধরনের বোমার সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারের বেশি৷ ১৯৪৯
সালের ২৯ আগস্ট তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম পরীক্ষা
চালায়। পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আরডিএস-১’। পারমাণবিক অস্ত্রের ওই পরীক্ষা
চালানো হয়েছিল কাজাখস্তানের সেমিপালাতিনস্কে। এর এক দশকের বেশি সময় পর ১৯৬১ সালে
পরীক্ষামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে
সময় ‘জার বোমা’ নামের একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। ওই বোমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
জাপানের হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে ৩ হাজার ৩০০ গুণ
শক্তিশালী ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট চলতি বছরের শুরুর দিকে এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছিল। তাদের হিসাব বলছে, বিশ্বের মাত্র ৯টি দেশের হাতে প্রায় ১২ হাজার ৭০০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। দেশগুলো হলো রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া। এই দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র আগেই ধ্বংস করেছে। তারপরও বর্তমানে দেশ দুটির হাতে রয়েছে বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশ।
১৯৮৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই
দেশের কাছে সর্বোচ্চ পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। সম্মিলিতভাবে সংখ্যাটা ৬৫
হাজারের কাছাকাছি। সে সময় স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্রের
ওই প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে
একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাই তাদের পারমণবিক অস্ত্রগুলো বর্জন করেছে। ১৯৮৯ সালে দেশটির
তত্কালীন সরকার পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প স্থগিত করে। পরের বছর তাদের ছয়টি
পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করা হয়। আরও দুই বছর পর পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে
একটি চুক্তিতে (এনপিটি) নাম লেখায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক
অস্ত্রবিহীন দেশ হিসেবে পরিচিতি পায় আফ্রিকার দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম
পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে এবং একমাত্র দেশ যারা এটা যুদ্ধে ব্যবহারও করেছে।
দেশটির কাছে এখন সাত হাজারের বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে।
ফ্রান্সের কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেড
আছে তিনশর মতো। এগুলোর অধিকাংশই রয়েছে সাবমেরিনে। দেশটির অন্তত একটি সাবমেরিন
সবসময় পারমাণবিক বোমা নিয়ে টহল দেয়।
আড়াইশর মতো পারমাণবিক বোমা আছে চীনের কাছে। রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও দেশটি ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়াচ্ছে। স্থল, আকাশ বা সমুদ্রপথে এসব বোমা ছোঁড়া সম্ভব। দুইশর বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে যুক্তরাজ্যের কাছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এই দেশটি ১৯৫২ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়।
এরই মধ্যে তিনবার প্রতিবেশী
ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তান। দেশটির আছে শতাধিক পারমাণবিক বোমা।
সাম্প্রতিক সময়ে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা বাড়িয়েছে দেশটি। অনেকে আশঙ্কা করেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে দেশটির লড়াই কোনো এক সময় পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে
পারে। ভারত প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ১৯৭৪ সালে। দেশটির কাছে নব্বইটির বেশি
আণবিক বোমা রয়েছে। ভারত অবশ্য জানিয়েছে, তারা আগে কোনো
দেশকে আঘাত করবে না। অন্যদিকে যেসব দেশের পারমাণবিক বোমা নেই, সেসব দেশের বিরুদ্ধে তারা এ ধরনের বোমা ব্যবহার করবে না কোনোদিন।
ইসরায়েল অবশ্য নিজের দেশের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে তেমন কিছু জনসম্মুক্ষে প্রকাশ করে না। দেশটির আশিটির মতো পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে বলে ধারণা করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার কাছে দশটির কম পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তবে দেশটির নিজেদের এ ধরনের বোমা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। ১৯৬৮ সালে একটি চুক্তি করা হয়। ‘নন-প্রলিফিরেশন অব নিউক্লিয়ার ওয়েপন’ নামের চুক্তিটির লক্ষ্য বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার।
ওই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য
ও ফ্রান্স ছাড়া স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর নিজেদের কাছে পারমাণবিক বোমা রাখা নিষিদ্ধ
করা হয়। এর বিনিময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি
ব্যবহারের অনুমতি পায় তারা। চুক্তিতে বলা হয়, এ
প্রক্রিয়ার পুরোটাই দেখভাল করবে জাতিসংঘ।
বর্তমানে এনপিটি চুক্তিতে
স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৯০টি। স্বাক্ষর না করা দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল ও দক্ষিণ সুদান। ১৯৮৫ সালে
উত্তর কোরিয়া ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। তবে ২০০৩ সালে সেখান থেকে সরে যায়
তারা। এর তিন বছর পর দেশটির তত্কালীন সর্বোচ্চ নেতা কিম জং–ইলের আমলে প্রথম
পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটায় উত্তর কোরিয়া।