‘যে চীনের গ্রেট ওয়াল ছুঁয়ে দেখেনি, সে নাকি পুরুষই না!’ অদ্ভুত হলেও এটি চীনের খুবই পরিচিত একটি প্রবাদ। চীনের মহাপ্রাচীরের কদর এতটাই। এর নাম শোনে নি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন।
গ্রেট ওয়াল
সম্পর্কে কিছু বেসিক ফ্যাক্ট
চীনের মহাপ্রাচীরকে ধরা হয় মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্কিটেকচার হিসেবে। প্রায় ২৩০০ বছর আগে এর কাজ শুরু করা হয়। পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য নিদর্শনের মধ্যে এটি একটি। সাংহাই পাসে শুরু হয়ে যা শেষ হয়েছে লোপনুরে গিয়ে। পাহাড় ও সবুজ বনভূমির উপর দিয়ে বিরাট এক অ্যানাকোন্ডার মতো একেবেকে প্রায় ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দেয়ালটি। বলা হয়, এর উপর দিয়ে একসময় একসাথে ১২ জোড়া ঘোড়া চলতো। চীনের মহাপ্রাচীর নিয়ে আরেকটি ইন্টারেস্টিং তথ্য হচ্ছে, এটি নাকি চাঁদ থেকে দেখা যায়। স্থানীয় জনগণের কাছে এই ধারণা খুবই পপুলার হলেও, আসলে এটা সত্য না। তবে কয়েকজন নভোচারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে এটি দেখতে পাওয়ার দাবি করেছেন।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
গ্রেট ওয়াল তৈরির
পেছনের ইতিহাস
এ তো গেল বেসিক কথাবার্তা। এবার আসা যাক ইতিহাসে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত সময়ে বেসিকালি চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না তৈরি করা হয়। এই সময়ে প্রায় একই রকম অনেকগুলো প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২২০ থেকে ২০০ এর মাঝামাঝি সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের বানানো প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। এর অবস্থান বর্তমান প্রাচীরের একদম উত্তরে।
প্রাচীরের মূল অংশের কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালের দিকে। চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংই এটি প্রথম ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। এরপরই তিনি ডিসিশন নেন যে, শত্রুর হাত থেকে নিজের কিংডম রক্ষা করার জন্য প্রাচীরটি আরো বড় করতে হবে। সেই সময় মাঞ্চুরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুরা ছিল খুবই ডেঞ্জারাস। তারা মাঝে মাঝেই চীনের বিভিন্ন অংশে অ্যাটাক করত। মূলত তাদের হাত থেকে চীনকে বাঁচাতেই গ্রেট ওয়াল তৈরির আইডিয়া এসেছিল সম্রাট কিন শি হুয়াং এর মাথায়। হান, সুই, নরদান ও জিং সাম্রাজ্যের পরবর্তী রাজারাও একই কারণে সেই ধারা বজায় রাখে। গ্রেট ওয়াল চীনের প্রায় ১৫টি প্রদেশ, কেন্দ্রীয় সরকারের ৯৭টি প্রশাসনিক এলাকা এবং ৪০৪টি ছোট ছোট শহরকে কভার করেছে। প্রাচীরটিকে মোট ১০ ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রাচীরের
বিভিন্ন অংশ
মুতিয়ান্যু - রাজধানী
বেইজিং থেকে ৭৩ কিলোমিটার দূরে গ্রেট ওয়ালের মুতিয়ান্যু অংশে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা
সময় লাগে। ঘুরে বেড়ানোর জন্য এই অংশটি খুবই নিরাপদ। বাচ্চা ফ্রেন্ডলি এরিয়াও বলা
চলে। এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বলতে গেলে প্রাচীরের অন্যতম সেরা অংশ। মুতিয়ান্যুর
একেবারে শীর্ষে যেতে পারে সাধারণ মানুষজনও। এর
একবারে চূড়ায় দাড়ালে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।
বাদালিং - বেইজিং থেকে
বাদালিংয়ে যাওয়াও খুবই সহজ। এই অংশের আকর্ষনীয় ফিচার হচ্ছে গ্রেট ওয়াল মিউজিয়াম। বাদালিং এর
উত্তর দিক থেকে ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত হাইকিং করা যায়। যদিও বেশিরভাগ ট্র্যাভেলার
মুতিয়ান্যু থেকেই আরামসে বাদালিং এ চলে আসে।
হুয়াংহুচেং - এই অংশে মানুষজন
একটু কমই যায়। কারণ এই অংশের রাস্তা কিছুটা কঠিন। তবে হাইক লাভারদের জন্য হুয়াংহুচেং পারফেক্ট
জায়গা।
জুয়োংগুয়ান - বেইজিং থেকেই
সহজে জুয়োংগুয়ানে যাওয়া যায়। এই অংশে একাধিক সুরক্ষিত দুর্গ আছে। হাইকিং করারও ব্যবস্থা আছে।
সিমাতাই – গ্রেট ওয়ালের
খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ সিমাতাই। জাতিসংঘের ইউনেস্কো থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ
সাইটের মর্যাদাও পেয়েছে এটি। এখানে ক্যাবল কার, ব্যাটারি কার্টস ও
বোটিং করার ব্যবস্থাও আছে।
এছাড়াও রাতের সিমাতাই খুবই জাঁকজমকপূর্ণ একটি এলাকা।
হুয়ানগ্যাগুয়ান – এই অংশে
প্রতি বছর মে মাসে ‘দ্য গ্রেট ম্যারাথন’ আয়োজন করা হয়। এখানে মানুষজন চাইলে
ট্যুরিস্ট বাসে করেও পাহাড়ের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখতে পারে।
সাংহাই পাস – এই অংশটি গিয়ে
মিলেছে সমুদ্রের সাথে। প্রাচীরের এই অংশটি আগে সীমান্ত রক্ষার কাজে ব্যবহার করা
হতো। সাংহাই পাস পুরোটা ঘুরে দেখার জন্য অন্তত একদিন সময় লাগে।
জিনশানলিং - বেইজিং থেকে
জিনশানলিংয়ে পৌঁছাতে প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এই অংশের সবথেকে এক্সাইটিং
ব্যাপার হচ্ছে এর অর্ধেকই জঙ্গলের ভেতরে। ট্র্যাভেলারদের মধ্যে তাই জিনশানলিং থেকে
সিমাতাই পর্যন্ত হাইকিং বেশ পপুলার।
গুবেইকো ও জিয়ানকো – এই অংশ দুটি
একটু স্পেশাল। কারণ এর পুরোটাই জঙ্গলে ঘেরা। তাই মানুষজনের জন্যেও অনেকটাই
বিপজ্জনক। সাধারণত এই
দুটি এরিয়াতে সাধারণ মানুষদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না।
প্রাচীরের
আশেপাশের স্পেশাল কয়েকটি শহর
গ্রেট ওয়ালের আশেপাশে স্পেশাল কিছু এলাকা আছে। এর মধ্যে
প্রথমটি হচ্ছে ‘ইয়ংতাই টার্টল সিটি’। ইয়োলো রিভার ডিফেন্স লাইনের অংশ হিসাবে মিং রাজবংশ ১৬০৮
সালে টার্টল সিটি তৈরি করে। যেখানে সেই সময়ে প্রায় ২,০০০ জন মানুষ এবং ৫০০ অশ্বারোহী ইউনিট ছিল।
টার্টল সিটি নাম শুনে অনেকে ভাবতে পারে এই এলাকায় হয়তো
কচ্ছপের ছড়াছড়ি! আসলে মোটেও সেরকম কিছু না। আকৃতির দিক দিয়ে এই গ্রামটি অনেকটা
কচ্ছপের মতো হওয়ায় এই ডাকনাম পেয়েছে। বর্তমানে চীনের সবচেয়ে প্রোটেক্টেড শহরগুলোর
মধ্যে টার্টল সিটি একটি।
এরপরে রয়েছে বাতাইজি। এই এলাকাটি মহাপ্রাচীরের মতিয়ানলিং
শহরের ঠিক ভেতরে। সেখানে ১৮৭৬
সালে নির্মিত একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ আছে। যা
একজন জার্মান ধর্মপ্রচারকের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। ১৫০ বছরের ইতিহাসে বহুবার
ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে এটিকে মেরামত করা হয়েছে। সুন্দর একটি সকাল বা বিকাল
কাটানোর জন্য বাতাইজি চমৎকার একটি জায়গা। এলাকাটি ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ সময় হলো
গ্রীষ্মের শেষের দিক।
সবশেষে আসবে পরি টাওয়ারের কথা। যেখানে গ্রেট ওয়াল বানানোর
কাজ শুরু হয়েছিল, সেই সিমাতাই অংশের সবচেয়ে পরিচিত
টাওয়ারগুলোর একটি হলো পরি টাওয়ার। কিন্তু এখানে ঢোকা বেশ কঠিন বলে খুব বেশি মানুষ
যায় না। এর বদলে তারা ওয়াংজিং টাওয়ার থেকে পরি টাওয়ারের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য্য
উপভোগ করে। মুতিয়ানু এবং
জিয়ানকুর মতো প্রাচীরের এই অংশটিও বছরের সবসময়ই ভয়ংকর সুন্দর থাকে।
ডার্ক সাইড অফ
দি গ্রেট ওয়াল
দ্য গ্রেট ওয়াল নিয়ে এত এত ফ্যাসিনেটিং ব্যাপার-স্যাপার
যেমন আছে, তেমনি আছে এর ডার্ক সাইডও। এটির সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজের সময়ে প্রায় ১০
লাখেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলো। যাদের কবর আছে এই প্রাচীরের ভেতরেই। তাই একে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবরস্থানও বলা হয়।