দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম সীমান্ত। সীমান্তজুড়ে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ আন্দিজ পর্বতমালা। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই আন্দিজে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য নয়, এই পর্বতমালা জুড়ে রয়েছে বিস্তর রহস্যের আনাগোনা।
১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর। আন্দিজ
পর্বতের বুকে আছড়ে পড়েছিল একটি বিমান।
ফ্লাইট
ফাইভ সেভেনটি ওয়ান। রাগবি
খেলার জন্য চিলি যাচ্ছিল উরুগুয়ে রাগবি দল ওল্ড ক্রিশ্চিয়ানস এবং তাদের সমর্থকরা। কিন্তু
হঠাৎই একটা ভয়াবহ শব্দ করে বিমানটা আন্দিজ পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ল। শেষ হয়ে
গিয়েছিল কয়েকটি তরতাজা জীবন।
যাঁরা
বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা
সকলের সামনে আনে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
ফ্লাইট ফাইভ সেভেনটি ওয়ান-এর যাত্রী ছিল রবার্ত।
৪০
জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিমানটি। গান-গল্প-হইহুল্লোড় করে ভালোই কাটছিলো। এমন সুন্দর
সময়ে,
এত অল্প বয়সে, পায়ের নিচে থাকা দুধসাদা বরফের
কোলে এমন কোনও বীভৎস অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, সেটা ভুলেও মাথায়
আসেনি কারও। বিমানের
জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিলেন রবার্ত।
হঠাৎ
মনে হলো,
বিমানের ডানাদুটো যেন বরফে ঢাকা আন্দিজের চুড়োর খুব কাছে। রবার্তের
কথায়,
"বুঝতে পারছিলাম আমরা আকাশের থেকে অনেকটাই নিচ দিয়ে যাচ্ছি।"
হঠাৎই একটা ভয়াবহ শব্দ করে
বিমানটা আন্দিজ পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ল।
যেন
ভয়াবহ একটা ঘুর্ণিঝড়ের মুখে এসে পড়েছে।
পাহাড়ের
ঢাল ধরে বিমানটা স্লেজগাড়ির মতো নেমে আসছিল। প্রচণ্ড
ঝাঁকুনিতে পর পর সবক'টা আসন যাত্রীদের নিয়েই উপড়ে আসতে লাগল সামনের
দিকে।
সব যখন শান্ত হলো, তখনও বোঝেননি রবার্ত, আদৌ বেঁচে আছেন কি না! সহযাত্রীদের কান্না আর আর্তনাদে আশেপাশের বাতাস ভারী। বিমানের অধিকাংশ অংশই ভেঙে পড়েছে। বরফ-সাদা পাহাড়ের অংশ দিব্যি দেখা যাচ্ছে আশেপাশে। হিম-ঠান্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। বাইরে তখন তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রির নিচে। আর বিমানের ভেতরে তাপমাত্রা প্রায় ৭৫ ডিগ্রি। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ গুরুতর আহত, কেউ বা কোমায়। যা খাবার ছিল, ক্রমশ তা ফুরিয়ে এল।
দুর্ঘটনার দশ দিনের মাথায়
ট্রানজিস্টর মারফৎ খবর আসে যে, তাঁদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা
করা হচ্ছে, তবে সময় লাগবে। কিন্তু
ততদিনে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তার
ওপর খাবার নেই। প্রাকৃতিক
দুর্যোগ আর খাবারের অভাবে, সেই সঙ্গে পর্বতের প্রবল ঠান্ডা।
এরপর নিজেদের মধ্যে 'ভয়াবহ' চুক্তি করলেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত
নেওয়া হলো, যাঁরা আগে মারা যাবেন, তাঁদের
মাংস খেয়ে বাকিরা বেঁচে থাকবে! যে সঙ্গীটি প্লেনের পাশের সিটে
বসেছিলেন, মারা যাওয়ার পর অবস্থার চাপে পড়ে তাঁরই মাংস খেতে
হয়েছিল। একমাত্র
আশা ছিল,
কেউ না কেউ, কোনও না কোনও দিন হয়তো তাদের খুঁজে
বের করবে। মৃত্যুর
আগে কিংবা পরে তাঁরা ফিরে যাবে মানুষের কাছে।
২৩ ডিসেম্বর, বিমান দুর্ঘটনার ৭২ নম্বর দিনে অবশেষে সাহায্য আসে। মোট ১৬
জন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
রবার্তদের
জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে, তা হয়তো ভাবেননি কেউই। কিন্তু, ওই দীর্ঘ ৭১ দিন সত্যি কি একদল মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য নরখাদকে পরিণত
হয়েছিল?
খিদে পেলে কোনও কিছু খাওয়া
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
আর
এই সহজাত প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের শরীরের মাংস কেটে
খেতে বাধ্য হয়েছিলেন আন্দিজ পর্বতের বিমান দুর্ঘটনার যাত্রীরা। একটি প্রতিবেদনে
পেদ্রো জানিয়েছেন, "বাঁচার জন্য স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়েও লড়তে
হয়েছিল। খিদের
মুখে বরফের মধ্যে পড়ে থাকা বন্ধুদের মৃতদেহ থেকে খাবলে নেওয়া মাংস একটা ধাতব পাতে
রেখে ঝলসে খেয়ে বেঁচেছিলেন ক'জন মানুষ।"
স্বজাতি-ভক্ষণ মানবসভ্যতায় কখনওই স্বীকৃতি পায়নি। মানুষ এমন
বীভৎস ঘটনাকে স্থান দেয়নি নিজেদের মধ্যে।
তবে
বাধ্য হয়ে একটা সময় পেদ্রোকে সেটাই করতে হয়। তাঁকে সঙ্গ
দেয় বাকীরাও।
কিন্তু কীভাবে পেরেছিলেন তাঁরা? মানসিক দৃঢ়তা ও বেঁচে থাকার জন্য হন্যে হয়ে স্বজাতি-ভক্ষণকেই নিজেদের বেঁচে থাকার পিছনের কারণ বলে মনে করেন ক্যানেসা ও পেদ্রো। নিজেদের
অতীত নিয়ে কি তাঁরা ক্ষমাপ্রার্থী? কখনও কি মনে হয় যে এমনটা
করে অপরাধ করে ফেলেছেন? এর উত্তর নিয়েও আছে ভিন্ন মত।
'ইনটু দ্য মাউন্টেইনস' নামের বইতে 'পেদ্রো' নিজের নির্মম আর অবিশ্বাস্য সেই ৭১ দিনের বেঁচে থাকার গল্প বলেন পুরো পৃথিবীকে। গল্পটা কেবল পেদ্রো আলগারতো-র একার নয়। এই গল্পে ছিলেন আরও ১৫ জন মানুষ, যাঁরা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে পেরেছিলেন মানবসভ্যতায়। এই ১৬ জনের একজন রবার্তো ক্যানেসা নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন 'আই হ্যাড টু সারভাইভ' নামের বইতে। এছাড়া ১৯৯৩ সালে এই ঘটনাকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র 'অ্যালাইভ'।
অনেকের পরিবার বিশ্বাস করতে
চায়নি প্রথমে যে, তাঁদের কেউ মানুষের মাংস খেয়েছে। তবে ধীরে
ধীরে সবাই বুঝতে পেরেছে।
"সেদিন মানুষের মাংস
না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আজ আমি এখানে থাকতাম না”, এটা বলে
নিজের কাজের প্রতি সম্মতি জানিয়ে কথা শেষ করেন পেদ্রো।