একসময় স্পেন ছিল মুসলমানদের দখলে। ১৪৯২ সালে খ্রিষ্টানরা রাজা বোয়াবদিলের কাছ থেকে গ্রানাডা দখল করে নেয়। ১৫০২ সালের দিকে শাসকরা অর্ডার দেয় দেশের সকল মুসলিমকে জোর করে খ্রিষ্টান ধর্মে কনভার্ট করার জন্যে। সেই সময় করতারের ইমাম আল ইয়েইয়ার পালানোর আগে নিজের ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে রেখে যান তিনটি বই। প্রায় ৫০০ বছর পরে সেগুলো খুঁজে পেয়ে রীতিমত হতবাক হয়ে যান গবেষকরা। কিন্তু কেন?
মোহাম্মদ আল-ইয়েইয়ার ছিলেন মাল্টিট্যালেন্টেড একজন মানুষ। কবিতা, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে ছিলেন একজন এক্সপার্ট। পাশাপাশি একজন দক্ষ বিচারকও ছিলেন তিনি। একবার তার এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পুরো দুনিয়াতেও সেগুলো কখনো হয়নি, যা যা হয়েছে আল-আন্দালুসে অর্থাৎ স্পেনে।’
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি সেভিয়াতে জেল খেটেছেন। সেই সময়ে গভর্নরের জন্য বই কপি করে দিতেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তাই তাকে আইন বিশেষজ্ঞ ও করতারের ইমামের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকেই তিনি জ্ঞান সাধনা চালিয়ে যেতে থাকেন। প্যাপিরাসের কাগজকে ডায়রি হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে মানুষজনের জমিজমা ও তালাক এর ব্যাপারে তার বিচার, তার নিজের মতামত থেকে শুরু করে ১৪৯২ সালে স্পেনের খ্রিস্টানদের গ্রানাডা বিজয়ের নানা ঘটনা উঠে এসেছে। সে সময়েই স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্যে ধ্বস নামে। সেই ডায়েরি থেকেই জানা যায় দেশের অন্যান্য মুসলিমদের মতো আল ইয়েইয়ারকেও জোর করে খ্রিষ্টান বানাতে চেয়েছিল তখনকার শাসকরা। তখন তিনি ঠিক করেন দেশ ছেড়ে পালাবেন। পালিয়ে যাওয়ার আগে বাড়ির দেয়ালের ভেতরে ১২ শতকের একটি কোরআন ও নিজের লেখা গবেষণাধর্মী দুটি বই লুকিয়ে রেখে যান।
এরপর কেটে গেছে বহুকাল। মাঝে ঘটে গেছে দুটি মহাযুদ্ধও। অবশেষে ২০০৩ সালে করতারের সেই গ্রামে রিকন্সট্রাকশন চলাকালীন শ্রমিকরা সেই বাড়িটির ইট সড়ানোর সময় কোরআনসহ সেই বই দুটি আবিষ্কার করে। ২০০৩ সালের ২৮ জুন খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ধরে দেয়ালেই লুকানো ছিল এই বইগুলো। বাড়ির বর্তমান মালিক মাগাডালেনা সান্তিয়াগো এই ঘটনায় আকাশ থেকে পড়েন। তিনি জানান এত বছর ধরে বইগুলো এখনো যে অক্ষত আছে সেটাই তো বিরাট এক রহস্য।
স্পেনের মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। দেশটিকে বহু বাড়ির দেয়ালেই এরকম অনেক পুরাতন বই খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে মাগাডালেনার বাড়ি থেকে খুঁজে পাওয়া এই কোরআনটি স্পেনের ইতিহাসের সবথেকে পুরাতন দুটি কোরআনের মধ্যে একটি। এটি এখন মালাগা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে। ২০ বছর ধরে এর উপর গবেষণা করেছেন আরবি ভাষাবিদ মারিয়া ইসাবেল কালেরা। তিনি জানান এটি তার দেখা সেরা আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি। স্প্যানিশ আর্কিওলজিস্টরা করতারে পাওয়া প্রাচীন এই বইগুলোর নাম দিয়েছেন ‘লস্ট ম্যানুস্ক্রিতোস দি করতার’। ২০০৯ সালে আন্দালুসিয়া সরকার কোরআনটির হুবহু একটি কপিও তৈরি করে রাখে। ইসাবেল কালেরার নেতৃত্বে বই তিনটি নিয়ে একটি গবেষনা গ্রন্থও বের হয়।
গবেষকরা জানান আলমোহাদ শাসকদের
সময়ে লেখা এই কোরআনটি শিল্পগত দিক থেকেও দারুণ সুন্দর। এটি তৈরি করা হয়েছে বাছুর ও
ভেড়ার চামড়ার পার্চমেন্ট ব্যবহার করে। লাল রঙের ফুল, সোলেমানি নট, কালো ও সবুজ রঙের ক্যালিওগ্রাফির মাধ্যমে চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে
এটি।