বিশাল নীল সাগর। সাগরের গভীর জলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছগুলো খেলছে, খাচ্ছে, ঘুরছে। হঠাতই কোনো শিকারী মাছ তাদের ধাওয়া করলো। তারা টের পেয়েই পানির উপরে উঠে দিলো উড়াল। কি অবাক লাগছে? যা দেখছেন, সব সত্যি। মাছগুলো পাখির মতোই বাতাসে উড়ছে। এদের নাম "সেইলফিন ফ্লাইং ফিস" বা উড়ুক্কু মাছ। উষ্ণ সমুদ্রীয় অঞ্চলেই এই ধরনের মাছ বেশি দেখা যায়। মূলত এদের শরীরে ডানার মত জোড়া পাখনা পানির উপর উড়তে বা লাফিয়ে চলতে সাহায্য করে। ওড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকার কারনে এই মাছকে শিকারে পরিনত করতে বড় বড় মাছদের বেশ বেগ পেতে হয়। আকাশে পাখি ওড়ার আট কোটি বছর আগে থেকেই উড়ুক্কু মাছের রাজত্ব। ডাইনোসরের আগে থেকেই এ মাছের অস্তিত্ব ছিল।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
পৃথিবীতে ৯ ধরনের ৬৪ প্রজাতির ফ্লাইং ফিস পাওয়া যায়। এই মাছ সাগরের
পানির উপরিভাগ থেকে ২০০ মিটার গভীর পর্যন্ত চলাচল করে বেড়ায়। তবে উড়ার ক্ষমতা থাকলেও
এসব মাছ পাখির মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশে ভেসে থাকতে পারে না। ফলে গবেষকরা এই উড়াউড়িকে
বলেন "গ্লাইডিং"।
গ্লাইড শেষে পানিতে নেমে এরা খুবই দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করে এবং পরবর্তী গ্লাইডিং এর জন্য পর্যাপ্ত গতি লাভ করে। এভাবে এরা পরপর সর্বোচ্চ ১২ টি গ্লাইড করতে পারে। ডেভেনপোর্ট ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ধারনা করেছেন যে, ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় উড়ন্ত মাছ সাধারণত লাফ দেয়া না । কারন এর থেকে কম তাপমাত্রা পেশীকে কাজ করতে বাঁধা দেয়। তাই এদেরকে সাধারণত উষ্ণ পানিতে দেখতে পাওয়া যায়।
জল ছেড়ে উড়ুক্কু মাছের হাওয়ায় ভাসার পেছনে থাকে দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমটা হল, প্ল্যাঙ্কটন। আর এই প্লাঙ্কটন খাওয়ার জন্য ফ্লাইং ফিসকে পানির ওপরে উঠতে হয়। দ্বিতীয়টা হলো, আত্মরক্ষা। বড় মাছ বিশেষ করে টুনা, ডলফিন, স্কুইডের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য জল ছেড়ে হাওয়ায় ভাসে তারা। ফ্লাইং ফিস প্রথমে জলের ওপর লাফিয়ে ওঠে। এরপর জোরে, দ্রুত গতিতে সাগরের জলে লেজ দিয়ে আঘাত করে। সেকেন্ডে ৭০ বারের মতো সাগরপৃষ্ঠে লেজ দিয়ে আঘাত করার পর সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অনেকটা রানওয়েতে বিমান টেকঅফের মতো। এরপর মাছগুলো ডানা মেল। একটি ফ্লাইং ফিস সাধারণত ৫০ মিটার বা ১৬০ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠতে পারে। আবার ক্ষেত্রবিশেষ এই দূরত্ব ৪০০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। উড়ুক্কু মাছের ওঠার গতিবেগ ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। বাতাসের গতি বা ঢেউয়ের অবস্থার উপর নির্ভর করে এরা ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।
পৃথিবীর অনেক জায়গায় ফ্লাইং ফিস ‘ফ্লাইং কড’ নামেও পরিচিত। এরা "এক্সোকোয়িটাইড" গোত্রের। এক্সোকোয়িটাইড শব্দটি গ্রীক এক্সোকোয়িটাস শব্দ থেকে এসেছে। শব্দটি প্রাচীন গ্রীসে এমন সব প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো যারা বাসস্থানের বাইরে ঘুমায়। স্টেভ হওয়েলসের বই “দ্যা অ্যামেইজিং ওয়ার্ল্ড অব ফ্লাইং ফিশ” এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে। “ex” মানে কোন কিছুর বাহিরে আর “koitos” অর্থ বিছানা । প্রাচীনকালে মাছের এই উড়ার ক্ষমতার কারণে মনে করা হতো- এই মাছ সারাদিন পানিতে বিচরণ করলেও রাতে ঘুমানোর জন্য তীরে উড়ে যায়। বাণিজ্যিক ভাবে জাপান, ভিয়েতনাম, বার্বাডোস, ইন্ডিয়াতে এই মাছটি প্রচুর ধরা হয়। বিপুল পরিমাণ উড়ুক্কু মাছের কারণে আমেরিকা মহাদেশের উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপের দেশ "বার্বাডোস" এর নামই ছিল উড়ুক্কু ‘মাছের ভূমি’ বা ‘ল্যান্ড অব ফ্লাইং ফিস’, এই উড়ুক্কু মাছ এই দেশের জাতীয় মাছও বটে।
১৯৪১ সালের দিকে যখন হাই স্পীড ক্যামেরা ব্যাবহার করা হয় তখন বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে তারা আসলে উড়ছে না । তারা তাদের পাখনা কে কাজে লাগিয়ে দ্রুত গতিতে গ্লাইড করছে। পানি থেকে লাফ দেয়ার পূর্বে তারা যথেষ্ট গতি অর্জন করে বাতাশে ভেসে থাকার জন্য ।
ফ্লাইং ফিস আলোর প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয় । ফলে জেলেরা সহজেই এদেরকে
আলোর লোভ দেখিয়ে ধরতে পারেন। রাতের বেলায় আলোকিত সংরক্ষিত পানিতে আলোর লোভ দেখিয়ে এদেরকে
শিকার করা হয়। তবে সম্প্রতি এই মাছের কিছু কিছু প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে। গ্লোবাল
ওয়ার্মিং এর কারনে উড়ুক্কু মাছের মাইগ্রেশনের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে। “লাইফ অফ
পাই” মুভিতে হয়তো অনেকেই এই উড়ন্ত মাছকে উড়তে দেখেছেন। এই অসাধারন, অপূর্ব, অনন্য বৈশিষ্টের
অধিকারি মাছটিকে আমাদের উচিত এই সুন্দর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে না দেয়া ।