প্রথম মমি বানানো হইছিল কবে বলেন তো? না, মিশরীয় যুগে না। প্রথম মমি তৈরি করা হইছিল চিলির কামারোনিস ভ্যালির চিনচোরো সভ্যতার একটি বাচ্চার মৃতদেহের উপরে। সেটা ৫০৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দের ঘটনা। মিশরে মমি কালচার শুরু হওয়ারও ২০০০ বছর আগের কথা।
বিভিন্ন কার্টুন ও সিনেমার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই ‘মমি’
শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আসলে মমি আমাদের মাথায় এমনভাবে গেঁথে গেছে
যে মিশরের নাম শুনলেই আমাদের চোখে মমি ও পিরামিডের ছবি ভেসে উঠে। মমি বলতে সাধারণত
আমরা বুঝি একটি মৃতদেহ যাকে এক ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সংরক্ষণ করা হইছে। সহজ ভাষায় বললে মমি হল ওষুধে মাখানো কাপড়ে জড়ানো
মৃতদেহ। মমি শব্দটা আসছে ল্যাটিন ‘মুমিয়া’ এবং পার্সিয়ান শব্দ ‘মুম’ থেকে। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় যত্নের সাথে প্রিজার্ভ করা মৃতদেহ।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
মমির রকমফের
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে মমি করে মৃতদেহ
সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। ইনকা সভ্যতা, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী,
প্রাচীন ইউরোপিয়ান সভ্যতা সহ আরও অনেক সভ্যতায় মৃতদেহের প্রতি
সম্মান দেখিয়ে সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছর ধরে মমিকরণ প্রথা
প্রচলিত ছিল।
কিছু মমি তৈরি হইছিল অ্যাক্সিডেন্টালি। যেমন, গুয়ানাজুয়াতো,
মেক্সিকোতে একশ এর বেশি মমির সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের ইচ্ছাকৃত
ভাবে মমি বানানো হয় নাই। ধরে নেয়া হয়, প্রচণ্ড তাপমাত্রা অথবা সেই এলাকার
মাটির নিচে বিপুল পরিমাণে সালফার ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের কারণে সেই মৃতদেহগুলো
মমিতে পরিণত হইছে।
মমি তৈরির
সবথেকে ভয়াবহ উদাহরণ
মমির ইতিহাসে সবথেকে শকিং ও হরিফিক ঘটনা বৌদ্ধ
সন্ন্যাসীদের ন্যাচারালি মমি হওয়ার ব্যাপারটা। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে মমিতে
রূপান্তরিত করে ফেলতো বছরের পর বছর অনশন করে ও সেই সব খাবার খেয়ে, যা খেলে মানবদেহ
ক্ষয় হয়। এই করে যখন তাদের দেহে আর কোন চর্বি বাকি থাকেনা, তখন
তারা বিষাক্ত কিছু খেত যা খেলে তাদের বমি হত ও বমির সাথে দেহের জলীয় অংশগুলো বের
হয়ে যেত। বিষাক্ত সেই পানীয় দেহকে মৃত্যুর পর পোকামাকড়ের হাত থেকেও রক্ষা করতো। এই
প্রসেসের শেষ ধাপে তারা নিজেদের মৃত্যু ও মমিতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা করতো। তাদের মৃত্যু হত ঠিকই, কিন্তু খুব কম সন্ন্যাসীর লাশই মমিতে পরিণত হত। এরথেকে ভয়ানক আর কি হতে
পারে?
সবথেকে প্রচলিত
মামিফিকেশন প্রসেস
প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত মৃত্যুর পর, মানুষ পরকালে তাদের জীবন আবার শুরু করবে। আর সেই জীবনে যাওয়ার জন্য
তাদের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আর এই সংরক্ষণ করে রাখার জন্য মমি তৈরি করা
হতো। তবে মমি কেবল মিশরের বড়লোক ও রেস্পেক্টেবল লোকদেরই তৈরি করা হতো। চলুন এবার
সেই প্রসেস সম্পর্কে জানা যাক।
১. মৃতদেহটিকে ধুয়ে নেয়া হত।
২. তলপেটের বাম দিকে একটা ছেদ কাটা হয় এবং সেই ছেদ দিয়ে
নাড়ীভুঁড়ি, যকৃত, ফুসফুস ইত্যাদি বের
করে ফেলা হয়। তবে হৃদপিণ্ড, শরীরের যে অংশকে মিশরীয়রা
অনুভূতি এবং বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র মনে করত, রেখে দেয়া হত
শরীরের ভেতরেই যাতে পরকালে ব্যবহার করতে পারে। দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো বের করার
পর ওই কাটা অংশকে তালের মদ দিয়ে পরিষ্কার করে, বিভিন্ন
গাছ গাছড়া এবং মসলা দেহের ভেতরে প্রবেশ করানো হত।
৩. হুকের মত একটা যন্ত্র ব্যবহার করা হত মাথা থেকে নাক
দিয়ে মগজ বের করার জন্যে। মগজকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হতনা। মগজ নাক দিয়ে বের করে
ফেলে দেয়া হত।
৪. শরীর এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ৪০ দিন ন্যাট্রন
লবণে মাখিয়ে রাখা হয় যাতে মৃতদেহ থেকে সব আর্দ্রতা বের হয়ে যায়।
৫. শুকনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো লিলেন কাপড়ে পেঁচিয়ে ক্যানোপিক
জারে ভরে রাখা হত। প্রতিটি জারের ঢাকনাগুলো দেবতা হোরাসের ৪ পুত্র - ইমসেটি, হাপি, ডুয়ামেটেফ, কেবেসেনুয়েফ এর আদলে তৈরি
ছিল। এগুলোতে যথাক্রমে যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলী ও অন্ত্র রাখা হতো।
৬. শরীর থেকে লবণ পরিষ্কার করে শুষ্ক চামড়ায় তেলের প্রলেপ
দেয়া হত।
৭. কাঠের গুঁড়া এবং কাপড়ের টুকরা দিয়ে শরীর প্যাঁচানো হত
এবং কাটা জায়গাটিকে মোম দিয়ে আটকে দেয়া হত।
৮. তারপর লিলেন কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে ১৫-২০ দিন ধরে প্রায়
২০ ধাপে মৃতদেহটি পেঁচিয়ে রাখা হত।
৯. ব্যান্ডেজের উপরে ডেথ মাস্ক বসিয়ে দেয়া হত।
১০. ব্যান্ডেজে মোড়ানো মৃতদেহটিকে একটা বড় কাপড়ের টুকরায়
আবৃত করা হত এবং পড়ে তা লিলেন কাপড়ের টুকরার সাহায্যে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হত।
১১. সবশেষে মৃতদেহকে নকশাকৃত মমি কেস বা কফিনে স্থাপন করা
হত। কফিনে মৃতব্যক্তির পরকালে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, মূল্যবান গয়না ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া হতো।
এই প্রসেসে মমি বানাতে প্রায় ৭০দিন লেগে যেত। আর একে মমি
বানানোর সবচেয়ে সুইটেবল ও ব্যয়বহুল উপায় হিসেবে ধরা হত।
আধুনিক যুগের
মমি
জেরেমি বেন্থাম - ১৮৩০ এর দশকে
ফিলোসফার জেরেমি বেন্থাম জানান মারা যাওয়ার পরে তিনি মমি হতে চান। তার মৃত্যুর পরে
তার দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী তার মমি তৈরি করা হয়। তবে তার মাথাটি সেই ভাবে তৈরি
করা সম্ভব হয় নি। তাই মোমের ব্যবহার করে মমির সাথে মিলিয়ে মাথা তৈরি করা হয়েছে।
তার মমিটি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ওপেন ডিসপ্লেতে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা আছে।
ভ্লাদিমির লেনিন - বিংশ
শতাব্দীর শুরুর দিকে রাশিয়ায় কসমিজম মুভমেন্ট খুবই জনপ্রিয়তা পায়। সেই সময়ে
নিকোলাই ফিয়দরোভিচ ফিয়দরোভ মৃত মানুষদের সায়েন্টিফিকালি পুনর্জন্ম দেওয়ার একটি
ধারণা দেন। আইডিয়াটি সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভ্লাদিমির লেনিনের
মৃত্যুর পরে লিওনিড ক্রাসিন ও আলেক্সান্দার বোগদানোভ লেনিনের বডি ও ব্রেইন
প্রিজার্ভ করে রাখার দাবী জানায়। যাতে করে ভবিষ্যতে কখনো তাকে পুনরায় জীবিত করা
সম্ভব হয়। কিন্তু কোনো এক কারণে পরে সেটা আর করা হয় নি। তবে লেনিনের বডি সুগন্ধির
দ্বারা প্রিজার্ভ করে মস্কোর রেড স্কয়ারের লেনিন’স টম্বে রাখা আছে। সাধারণ
মানুষরাও চাইলে সেখানে গিয়ে লেনিনকে দেখতে পারে। জোসারের পিরামিড ও সাইরাসের
টম্বের উপর ভিত্তি করে এই স্মৃতিসৌধটি ডিজাইন করেছেন আর্কিটেক্ট আলেক্সেই শুসেভ।
গটফ্রিড নচে – নাইনটিন্থ
সেঞ্চুরিতে ভেনিজুয়েলায় গটফ্রিড নচে নামক এক জার্মান ডাক্তার লা গুয়াইরার পাশের
জঙ্গলে একটি ল্যাব তৈরি করে সেখানে মামিফিকেশনের উপরে গবেষণা শুরু করেন। তিনি
সেখানে অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করে একটি স্পেশাল ফ্লুইড তৈরি করেন, যার ব্যবহার
করে দেহের ভেতরের অর্গানগুলো বের না করেই মৃতদেহের মমি তৈরি করা যাবে। তবে তিনি
সেই ফর্মুলা কখনো রিভিল করে যান নি।
অ্যালান বিলিস – ২০১০ সালে
ফরেন্সিক আর্কিওলজিস্ট স্টিফেন বাকলির টিম অ্যালান বিলিস নামক এক ব্যক্তির লাশ
দিয়ে মমি তৈরি করতে সক্ষম হন। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে তারা মিশরীয় পদ্ধতি
ব্যবহার করে কাজটি করেন। সম্পূর্ণ প্রসেসটি শ্যুট করা হয়। পরে যেটি ‘মামিফায়িং
অ্যালানঃ ইজিপ্ট’স লাস্ট সিক্রেট’ নামক ডকুমেন্টারি হিসেবে মুক্তি পায়। বিলিস
টার্মিনার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যুর পরে তার বডিকে
যেন মমি বানিয়ে প্রিজার্ভ করে রাখা হয়। সেটি এখন লন্ডনের গর্ডন মিউজিয়ামে রাখা
আছে।