সিনেমায়
যখন আমরা নায়ক বা নায়িকা, অথবা কোনো প্রিয় চরিত্রকে মারা যেতে দেখি, তখন হয়তো কিছুটা খারাপ লাগে। পরেই মনে হয়, আরেহ! এটা তো একটা সিনেমা। একই অভিনেতাকে গল্পের স্বার্থে বিভিন্ন সিনেমায় মারা যাওয়ার অভিনয় করতে দেখা যায়। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। তবে আপনি কি শুনেছেন, এমনই একটা সিনেমায় কেন্দ্রিয় চরিত্রের মৃত্যু দর্শকরা মেনে নিতে পারেনি। একজন দুজন নয় হাজার হাজার মানুষ রীতিমতো আন্দোলন শুরু করেছিলো। কেনো চরিত্রটাকে মারা হলো!!
১৯৯০
সালে ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ এর ধারবাহিক নাটক “কোথাও কেউ নেই”। নাটকটির রচয়িতা ছিলেন শ্রদ্ধেয় “হুমায়ুন আহমেদ”। সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন “আসাদুজ্জামান নূর”। তার চরিত্রের নাম ছিল “বাকের”। তাকে সবাই চিনতো বাকের ভাই নামে। নাটকের এক পর্যায়ে বাকের ভাইকে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। নাটকটি দর্শকদের অনুভূতির সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিলো যে, তারা এই রায় মানতে পারেনি।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
১৯৯৩ সালে ২২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় ‘বাকের ভাইয়ের’ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তখন নাটকে নয়, বাস্তবেই ‘বাকের ভাইয়ের’ ফাঁসি রুখতে আন্দোলন হয়েছিল। দুই বছর ধরে চলা নাটকটি টিভি দর্শকদের মনে এতোটাই স্পর্শ করে যে, এক পর্যায়ে ‘বাকের ভাইয়ের’ ফাঁসি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না দর্শকরা। বাকেরের ফাঁসি হোক-এটা কেউ চায় না, সবাই তার মুক্তি চায়। মুক্তির দাবি জানিয়ে তখন মিছিল করেছিল চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ছাত্ররা নিউ মার্কেটের মোড়ে, মিছিল হয়েছিল ঢাকায়, খুলনায়, রাজশাহীতে, ময়মনসিংহে। দেয়ালে লেখা হয়েছিল ‘বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’, নাট্যকারের বাসার সামনে পোস্টার লাগানো হয়েছিল, ‘কুত্তাওয়ালীর ফাঁসি চাই, বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’ একটি নয়, দুটি নয়, গুণে গুণে ৮০০ টি চিঠি পৌঁছেছিল হুমায়ূন আহমেদের ঘরে এবং ফোনে হুমকিও দেয়া হয়। কিন্তু নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ এসবের তোয়াক্কা না করে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দিয়ে দেন।
নাটক শেষ হয়। রেশ থেকে যায়। ২০১৬ সালে ‘দি কমেডি কোম্পানি’ নামের এক অনুষ্ঠানে এসে ‘বদি’ চরিত্রের অভিনেতা আব্দুল কাদের জানায়, “শেষের দিকে যখন দেখা গেল বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে, এটা প্রচার হয়ে গেল পত্রিকায়, আমি ভয় গেয়ে গেলাম। কারণ সাক্ষ্য আমাকে দিতে হবে রাজসাক্ষী হিসেবে; একটা মিথ্যা সাক্ষী, যার কারণে উনার ফাঁসি হবে। তখন কিন্তু মিছিল হচ্ছে, অনেকে ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগান তুলেছেন। আমার বাড়ির চারপাশে অনেক পোস্টার লাগানো হয়েছিল। পোস্টারে লেখা ছিল ‘বদি তুমি সাক্ষী দিলে, ভাসবে তুমি খালে বিলে’। তো আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তখন আমি হুমায়ূন ভাইকে বললাম বাকেরের ফাঁসি না হলে হয় না! আপনি শেষ পর্বটা ঠিক করে দেন। উনি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে বললেন, ‘বাকেরের ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না”। তিনি আরো বলেন, “শেষ পর্ব প্রচারের দিন আমার কাছে ফোন এসেছে এক ভদ্রলোকের, উত্তরা থেকে। তিনি ফোন দিয়ে বলছেন, ‘আমার বাচ্চা তো কানতেছে খুব, বাকের ভাই মারা গেছে। আপনি একটু বলে দেন যে মারা যায়নি’। তখন আমি বলে দিলাম, বাকের ভাই মারা যায়নি”।
বাস্তবতা এখন ভিন্ন। বাকের ভাইয়ের বয়স হয়ে গেছে, চুলে পাক ধরেছে মুনারও। বদি চলে গেছেন না ফেরার দেশে, অভিনয়ে ব্যস্ত মজনু। বাস্তব জীবনে এখন কেমন আছেন কুত্তাওয়ালী? মামুন, বকুল, ডাক্তার সাহেব, মতি- ওরাই বা নিজ নিজ জীবনে কী করছে এখন? ৯০ দশকের এই নাটকের চরিত্রগুলো আজও মানুষের মনে রয়ে গেছে অমর স্মৃতিগাঁথা হয়ে।