মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের একটি শহর স্ট্রাসবার্গ। ১৫১৮ সালের জুলাই মাসের
কথা। অন্যান্য দিনের মতোই দিব্যি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ‘ফ্রাঁউ ট্রফিয়া’ নামক এক
গৃহবধূ। হঠাৎ আশাপাশের সবাইকে চমকে দিয়ে সকালবেলা নাচতে শুরু করলেন তিনি। নাচতে নাচতে
বেরিয়ে এলেন প্রধান সড়কে। রাস্তার সকলে মজা পেয়ে হাসতে লাগল, অতি উৎসাহী কয়েকজন হাততালি
দিয়ে উঠল এবং চেঁচিয়ে ‘ট্রফিয়া’কে বাহ!বা দিতে লাগল। কেউ কেউ ভাবতে লাগলো, ট্রফিয়াকে
হয়তো ভূতে ধরেছে?
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেল এটা কোনো ভূতের কারসাজি নয়। ট্রফিয়া নাচছে
তো নাচছেই। তার চোখে-মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে সে
নাচ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, রাত হয়ে গেল; তারপর এলো পরদিন
সকাল। কিন্তু নাচ থামল না ট্রফিয়ার। পাক্কা ছ’দিন ধরে বিরামহীনভাবে নেচেই চলল সে। এক
সপ্তাহের মধ্যে আরও প্রায় ৩৪ জন যোগ দিল তার সাথে। মাস শেষে সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়াল চারশতে!
এই ড্যান্সিং ম্যানিয়ার ফলে প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন করে নাগরিক মৃত্যুবরণ করতে লাগল।
শরীরের উপর দিয়ে অমানুষিক ধকল যাওয়ার কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক আর ক্লান্তিতে নিঃশেষিত
অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তারা। অনেক ভেবেচিন্তে দেশটির সরকার নাচানাচি বন্ধ
করার উপায় হিসেবে সঙ্গীতজ্ঞদের ভাড়া করে আনলেন। ব্যাপারটা অনেকটা বিষে বিষে বিষক্ষয়ের
মতো। শহরের মাঝখানে বিশাল এক মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হলো। কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন ঘটা করে
নাচের শখ এবার অচিরেই পালাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হলো তার ঠিক উল্টো। “ড্যান্সিং ম্যানিয়া”
নামক এই পাগলামিতে দলে দলে যোগ দেয়া শুরু করল শহরের অন্যান্য বাসিন্দারা। গান-বাজনার
তালে তালে মৃত্যু হতে থাকলো আরও বেশি সংখ্যক মানুষের।
ড্যান্সিং প্লেগ এমন মহামারী আকার ধারণ করল যে লোকজন ‘ট্রফিয়া’
সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হলো। মধ্যযুগে ডাইনি প্রথার খুব প্রচলন ছিল। ডাইনি সন্দেহে
পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে অনেক নিরপরাধ নারীকে, এমন নজিরও রয়েছে। কিন্তু ট্রফিয়াকে খুন
করার মতো মানুষই বা কোথায়? প্রতিবেশীরাও তখন তার সাথে নাচতে ব্যস্ত। কাজেই ভিন্ন আঙ্গিকে
চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হয় গবেষকদের। কী করলে থামবে এই তাণ্ডব নৃত্য?
ঐতিহাসিক “জন ওয়ালার” তার ‘এ টাইম টু ড্যান্স’, ‘এ টাইম টু ডাই:
দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি অফ দ্য ড্যান্সিং প্লেগ অফ ১৫১৮’ বইটিতে পুরো ঘটনার বিবরণ
দিয়ে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করেন। বইটিতে উল্লেখ্য;
“প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ঘটনাটিকে আমরা নাচ বলে দাবি করছি আদৌ কী
তা নাচ ছিল, নাকি পাগলের মতো হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি ছিল। ঐতিহাসিক রেকর্ড বলে ভিক্টিমরা
কেবল কাঁপছিল বা হাত-পা ছুঁড়ছিল না, তাদের হাত-পায়ের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছিল কেউ জোরপূর্বক
তাদের দিয়ে নাচাচ্ছে”।
ড্যান্সিং ম্যানিয়ার শারীরিক বা রাসায়নিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে এগিয়ে
আসেন “ইউজেন ব্যাকম্যান”। ১৯৫২ সালে তার ‘রিলিজিয়াস ড্যান্সেস ইন দ্য ক্রিশ্চিয়ান চার্চ
অ্যান্ড ইন পপুলার মেডিসিন’ বইটিতে তিনি ও তার সমসাময়িক কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “স্যাঁতস্যাঁতে
এক প্রকার ঘাস থেকে জন্ম নেয়া এরগোট নামক এক ধরনের রোগাক্রান্ত উদ্ভিদই এই ড্যান্সিং
ম্যানিয়ার জন্য দায়ী।“
অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ‘রবার্ট’ একটি
সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করে। তার মতে, “নৃত্যকারিরা কোনো এক নতুন ধর্মের দিশা
পেয়ে স্বেচ্ছায় নাচতে নাচতে মৃত্যুবরণ করে”। কিন্তু জন বলেন “নৃত্যকারিরা স্বেচ্ছায়
নাচছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং সে সময়কার বিভিন্ন ছবিতে ফুটে ওঠা তাদের শারীরিক ভাষা
অনুযায়ী স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাচানো হচ্ছিল। চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি
না থাকলেও চিকিৎসকদের কাছে নেয়ার পর তারা ভয় এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বলে লিখিত
প্রমাণ আছে”।
তবে ড্যান্সিং প্লেগের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ‘ইভান ক্রোজিয়ার’। ডিসকভারি নিউজকে দেয়া এক তথ্যমতে, জনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন তিনি। পুরো বিষয়টিকে তিনি ‘মাস হিস্টিরিয়া’ বলে অভিহিত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে এরকম একটি ‘মাস হিস্টিরিয়া’ হয়েছিল বলে জানা যায়। সে সময় অকস্মাৎ মানুষের শরীর কুঁচকে আসতে থাকে। আফ্রিকা আর এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাইলের পর মাইল এলাকা থেকে লোকজন যেন বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যদিও ১৫১৪ সালের দিকে এই মহামারি কমে গিয়েছিলো।
কেউ বলে প্রেতাত্তা, কেউ বলে কোনো বিষাক্ত উদ্ভিদের সংক্রামণ। তবে
কেনো? কিভাবে এই মহামারি তার প্রভাব বিস্তার করেছে, তা আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।