১৫ নভেম্বর, ১৯১৩ সাল। দিনেন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চৌপাহাড়ির শালবনে ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এমন সময় কলকাতা থেকে খবর এল যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ “সঙ অফারিংস (Song Offerings)”এর জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন! এই নোবেল পুরস্কার শুধু সাহিত্যেই নয়, পুরো উপমহাদেশের জন্যই ছিল প্রথম নোবেল!
২৫ মার্চ ২০০৪ সাল। শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। এখানেই বিশ্বকবি নির্মিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার বিশ্বভারতীর ক্লাস বন্ধ থাকে। তাই পরদিন বৃহস্পতিবার স্বভাবতই একটু বেশি ব্যস্ততা থাকে শান্তিনিকেতনে। শুধু ব্যস্ততা নয়, তার সঙ্গে সময়ের সবচেয়ে দুঃখজনক খবরটাই বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র-ভবন তথা রবীন্দ্র-সংগ্রহশালার জানালার গ্রিল ভেঙে চোর ঢুকেছিল!
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
এ খবর শুনতেই শাঁই শাঁই করে ভ্যান ছুটিয়ে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল গোটা রবীন্দ্র-ভবন! ভবনের পেছনে ভাঙা জানালায় পাওয়া গেল ২৮ জোড়া পায়ের ছাপ। তার মধ্যে আবার দুজনের পায়ের হাওয়াই চপ্পলের ছাপ। কিন্তু তাতে আর লাভ কি? যা চুরি যাওয়ার তা তো ততক্ষণে চুরি হয়েই গেছে! চুরি গেছে মোট ৩৭টা জিনিস। মৃণালিনী দেবীর বালুচরি শাড়ি, রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার আংটি, সোনা-রুপোর কিছু জিনিসপত্র, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় সোনার পকেট ঘড়িসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারের মানপত্র এবং সাথে নোবেল পদকটাই চুরি হয়ে গেছে। যে পদকটা এখন পর্যন্ত বাঙালিদের পাওয়া শ্রেষ্ঠ অর্জনের ভেতর অন্যতম!
সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ খোঁজ ডাক উঠল চারদিকে! মুহূর্তেই সাড়া পড়ে গেল পুরো ভারতবর্ষেই। ক্ষোভে ফেটে পড়ল অনেকেই। মোক্ষম একটা হাতিয়ার পেয়ে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িও হলো প্রচুর। পশ্চিমবঙ্গের সে সময়ের বিরোধী দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুরির দায় চাপালেন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের ওপর। ক্ষমতাসীনেরাই বা বসে থাকবে কেন! তাই কেউ কেউ উল্টো বিরোধী দলকেই এই চুরির দোষ দিয়ে বসলেন! অনেকেই বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য সুজিত কুমার বোস ও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির পদত্যাগের দাবিও তুলে ফেললেন।
নোবেল চোর ধরার জন্য উঠেপড়ে লাগে ভারতের প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থা! সিবিআই, সিআইডি থেকে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, সবাই আদাজল খেয়ে লেগে যায় নোবেল চোর এবং চুরি যাওয়া নোবেল পদকের সন্ধানে। কিন্তু কোনোভাবেই এই চুরির কিনারা করতে পারছিল না কেউই।
তদন্তের অগ্রগতিও একেবারে শূন্যর কোঠায়! নোবেল চুরির বছর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর তদন্ত অগ্রগতি প্রায় শূন্য। সফলতা বলতে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একজনকে নোবেল চোর সন্দেহে ঢাকার আজিমপুর থেকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের সিআইডি পুলিশ। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয় না। পাওয়া গেল না কোনো কিছুই। শেষমেশ বিশ্বকবির নোবেল পদকের আসল চোর ধরতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল চুরির কেসের তদন্তের কপাট বন্ধ করে দেয় ভারতের সিবিআই।
এখন পর্যন্ত নোবেল পদক উদ্ধার কিংবা চোর ধরা পড়া তো দূরে থাক, ঠিক কী উদ্দেশ্যে চোর সেটা চুরি করেছে, সেটাই জানা যায়নি। কীভাবে তারা চুরি করল, কেন চুরি করল, চুরি করে তারা কোথায়ই-বা হাওয়া হয়ে গেল, নোবেলের সোনার পদকটা দিয়ে তারা ঠিক কী করল, সেটা আজ অবধি এক বিরাট রহস্য! এই রহস্য কি আরও ১০০ বছরেও রহস্যই থেকে যাবে? নাকি কখনো মুখ খুলবে হারিয়ে যাওয়া নোবেল? এ প্রশ্নের জবাব কারও কাছেই নেই! এটা আজও এক রহস্যই হয়ে আছে সবার কাছে।
বলে রাখা ভালো, শুধু বিশ্বকবিই নন, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিজ্ঞানী ‘আরনেস্টও লরেন্সে’র নোবেল পদকখানাও চুরি হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ‘কাই মিলারে’র নোবেলটিও দুষ্কৃতকারীরা চুরি করে নিয়ে যায়। তবে মিলারের নোবেল চোর ধরা পড়ে গিয়েছিল।