ঝন্টু বিরিয়ানি হাউস। রাস্তার পাশের মাঝারি আকারের একটি রেস্তোরা। অফিস পাড়ার কাছাকাছি হওয়ায় সকাল সকাল প্রচুর মানুষ আসে নাশতা করতে। প্রতিদিনের মতো আজকেও প্রচণ্ড ভীড় হইছে রেস্তোরার ভেতরে। পরোটার সাথে সবাই সমানে মাংস অর্ডার করতেছে। দোকানের ভেতরে হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল। একটা লোক টেবিল ছেড়ে উঠে আসছে। বাকি কাস্টমার সবাই তো পুরা ভড়কায় গেছে। সবাই তার কাছে গিয়ে জানতে চাইলো কি হইছে? লোকটা কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের প্লেটের দিকে ইশারা করলো। প্লেটের দিকে তাকিয়ে সবার তো চক্ষু চড়কগাছ! মাংসের বাটির ভেতরে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে মানুষের একটা বুড়া আঙ্গুল।
এই গল্পটা নিশ্চয়ই আপনিও কখনো না কখনো শুনছেন? শোনার পরে নিশ্চয়ই একবার হইলেও ভাবছেন, মানুষের মাংস কি আসলেই খাওয়া যায়? এটিকেই বলা হয় ক্যানিবালিজম।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
নাম্বার ওয়ান – এক্সো ক্যানিবালিজম
এই এক্সো-ক্যানিবালিজম জিনিসটা আসলে কি? খুবই সিম্পল। নিজ
জাতির বাইরের মানুষ পেলে তাকে খেয়ে ফেলা। পাপুয়া
নিউগিনির মিয়ামিন উপজাতির লোকজন এই কাজটা করতো। এরা মাঝে মধ্যেই আশেপাশের গ্রাম
গুলোতে হানা দিত। সেখান থেকে লোকজন ধরে নিয়ে আসতো। তারপর সেই মানুষগুলাকে আগুনে
পুড়িয়ে বারবি কিউ করে খেয়ে ফেলতো। তাদের এই অত্যাচারে এক পর্যায়ে আশেপাশের সব জাতি
একে একে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। সেই সময়ে একজন অ্যান্থ্রোপলজিস্ট সাহস করে এই
ব্যাপারে ঘাটাঘাটি করতে সেখানে গিয়েছিলেন। মিয়ামিনদের একজনকে ধরে তিনি জিজ্ঞেসও
করেছিলেন, কেন তারা এভাবে প্রতিবেশী জাতিদের ধরে খেয়ে ফেলতেছে? মিয়ামিন সেই লোকের
সিম্পল জবাব ছিলো, “কারণ ওদের মাংস খেতে মজা লাগে।”
নাম্বার টু – ওয়ার পলিটিকাল ক্যানিবালিজম
প্রাচীনকালে যুদ্ধের ভেতরেও ক্যানিবালিজমের চর্চা ছিল।
অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতো যুদ্ধে বন্দি হওয়া প্রতিপক্ষ সৈন্যদের মাংস খেলে দেবতা
খুশি হন। আবার সপ্তম শতকে প্রাক-ইসলামিক যুগের
আরবেও ক্যানিবালিজমের উল্লেখ পাওয়া গেছে। কোরাইশদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধের এক
পর্যায়ে মুসলিম বীর হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব মারা গেলে তার শরীর থেকে কলিজা বের
করে খেয়ে ফেলে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের ওয়াইফ হিন্দা। এবং এইটা হিস্টোরিকালি
কারেক্ট একটা ফ্যাক্ট।
আবার আমাজনের ওয়ারিরা ছিল পুরাই তারছিড়া লেভেলের পাগলা।
তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে সেই লোকের দেহের বিভিন্ন অংশ কেটে কেটে সবার মধ্যে
বিলিয়ে দিতো। তারা বিশ্বাস করতো, প্রিয়জনের মগজ ও হৃৎপিণ্ড খেলে বুদ্ধি ও
মন-মানসিকতা আরো ভালো হয়।
এছাড়াও ক্যানিবালিজম ব্যাপারটা অনেক জায়গায় পলিটিকাল
পাওয়ার খাটানোর ওয়ে হিসেবেও উঠে আসছে। এখনো আফ্রিকান বিভিন্ন ক্যানিবাল লিডাররা
হরহামেশাই তার নিচের লেভেলের কাউকে ধরে খেয়ে ফেলে।
নাম্বার থ্রি –
সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট
১৯৭২ সাল। একটি যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিলির
আন্দেস পর্বতে গিয়ে পড়ে। অল্প কয়েকজন বাদে বিমানে থাকা বাকি সবাই-ই মারা যায়।
কয়েকদিনের মধ্যেই বিমানে মজুদ থাকা খাবার ও পানিও শেষ হয়ে যায়। দুর্গম সেই পরিবেশে
বেঁচে থাকার তাগিদেই এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাইরে থেকে কোনও সাহায্য না
আসা পর্যন্ত মারা যাওয়া লোকজনের মাংস খেয়েই ক্ষুধা মেটাবে।
এভাবে তারা ৭০ দিন কাটায়। পরিস্থিতিটা একবার চিন্তা করেন! ৭০ দিন পরে তাদের উদ্ধার
করার জন্য রেসকিউ টিম আসে। রেসকিউ টিম সেখানে গিয়ে ১৬ জন যাত্রীকে জীবিত অবস্থায়
পেয়েছিল। সাথে পেয়েছিল কিছু ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ।
নৌপথেও এরকম বহু ঘটনার উদাহরণ আছে। ধরেন
আপনার জাহাজ এমন কোনো এক জায়গায় আটকে গেছে যেখানে আশেপাশে কোনো কুল-কিনারা নেই।
সাথে মজুদ থাকা খাবারও সব ফুরিয়ে গেছে, তখন আপনি কি করবেন?
নিজে মরে গিয়ে অন্যদের খাবারে পরিণত হবেন? নাকি বেঁচে থাকার তাগিদে মরে যাওয়া কোন সহযাত্রীকে খেয়ে ফেলবেন?
নরমালি এইসব পরিস্থিতিতে লোকজন ডারউইনের ‘সার্ভাইভাল অফ
দ্য ফিটেস্ট’ রুলস ফলো করে। অর্থাৎ দুর্বলরা মরে গিয়ে স্ট্রংদের খাবারে পরিণত হবে।
নাম্বার ফোর –
সিরিয়াল কিলারদের বিকৃত চর্চা
ক্যানিবালিজমের ভয়ংকরতম উদাহরণ আসলে পাওয়া গেছে আধুনিক
সমাজেই। আমরা বিদেশী সিনেমা কিংবা সিরিজে রেগুলারলি সিরিয়াল কিলারদের দেখি।
বাস্তবে আমাদের এই উপমহাদেশে সিরিয়াল কিলিং এর ঘটনা খুবই রেয়ার হইলেও, পশ্চিমা
বিশ্বে এই জিনিস কিন্তু ব্যাপক হারে আছে। সিরিয়াল কিলাররা সাধারণত কি করে? একটা
প্যাটার্ন অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের মানুষজনকে ধরে এনে মেরে ফেলে। তবে কিছু কিছু
মানুষরুপী পিশাচ আছে যারা শুধু সিরিয়াল কিলিং করেই থামে না, এরা রীতিমত সেই
ভিক্টিমের মাংসও খায়।
ইতিহাস ঘাটলে প্রচুর ক্যানিবাল সিরিয়াল কিলার পাওয়া যায়।
জেফরি ডাহমার থেকে শুরু করে অ্যালবার্ট ফিশ, আন্দ্রে চিকাটিলো, অ্যান্থনি মরলি,
লুকা ম্যাগনোটা, রুডি ইউজি, অস্টিন হারৌফ, তামারা সামসোনোভা, হোয়াকিম ক্রোলের মতো
কুখ্যাত সব সিরিয়াল কিলারই ক্যানিবাল ছিলেন। এদের মধ্যে জেফরি ডাহমার ছিলেন এক কাঠি
সরেস। তিনি নিজে তো ভিক্টিমের মাংস
রান্না করে খেতেনই, মাঝে মধ্যে প্রতিবেশীদেরও না জানিয়ে খাইয়ে দিতেন। ব্যাপারটা
ভয়াবহতা বোঝার জন্য একবার সেই প্রতিবেশীদের জায়গায় নিজেকে চিন্তা করে দেখেন।
ক্যানিবালিজম টার্মটা এখন সাহিত্য কিংবা সিনেমাতেও ব্যাপক
পরিমাণে জনপ্রিয়তা পাইছে। এরমধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্র হচ্ছে টমাস হ্যারিসের লেখা ড.
হ্যানিবাল লেক্টার। সিনেমা অ্যাডাপ্টেশনে অ্যান্থোনি হপকিন্সের নার্ভ চিলিং অভিনয়
এই চরিত্রটাকে পুরা দুনিয়ায় আরো বেশি ফেমাস করে তুলছে।
রিসেন্টলি আমাদের দেশী সাহিত্যেও ক্যানিবালিজম উঠে আসছে। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ
এখানে কখনো খেতে আসেন নি’ উপন্যাসটি দুই বাংলায় ব্যাপক হিট হইছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র
মুশকান জুবেরী সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রেন্ডে পরিণত হইছে। বছরখানেক আগে ফেমাস ইন্ডিয়ান
ডিরেক্টর ও আমাদের দুলাভাই সৃজিত মুখার্জী এই উপন্যাস থেকে ওয়েব সিরিজও নির্মাণ করছেন।