সেসময় রাজ্জাক কেবল সিনেমায় পা রেখেছে। অন্যদিকে পরিচালক জহির রায়হান তার “বেহুলা” সিনেমায় লখিন্দরের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মানানসই একজনকে খুঁজছিলেন। তখনকার সময়ের জনপ্রিয় নায়কদের মধ্যে কাউকেই তার পছন্দ হলো না। তিনি তার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে রাজ্জাককে ডেকে আনলেন। প্রাথমিকভাবে রাজ্জাককে তিনি সিলেক্ট করলেও, চরিত্রের জন্য রাজ্জাককে এক সপ্তাহ দাঁড়ি শেভ না করে থাকতে হলো। এক সপ্তাহ পর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে দেখে জহির রায়হান রাজ্জাককেই লখিন্দর চরিত্রের জন্য নিয়ে নিলেন। আর ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া বেহুলা সিনেমাটি বেশ ভালো সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। হয়েছিলো তুমুল জনপ্রিয়। চলুন জেনে কথা বলা যাক নায়ক রাজ রাজ্জাকের সেরা ১০ সিনেমা নিয়ে।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
বাবা কেনো চাকর
১৯৯৭
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বাবা কেনো চাকর’ ছিলো একটি পারিবারিক সিনেমা। সিনেমাটি যারা দেখেছে
তারা যত শক্ত মনের মানুষই হোক না কেনো, সিনেমার একটা পর্যায়ে গিয়ে অবশ্যই তাদের মন
একটু হলেও কেঁদেছে। বিশেষ করে রাজ্জাক পুরো সিনেমাকে তার অদ্ভুত দক্ষতায় সাজিয়েছেন।
একটা সিনেমার গল্প শুরুতেই বেদনার হয় না। সুখী পরিবার ধীরে ধীরে যখন স্বার্থপরতার দিকে
ঝুঁকে পড়ে ঠিক তখনই সেখানে বাসা বাঁধে এক ভয়ংকর অসুখ। আর এই অসুখ থেকে শুরু হয় ভাঙন।
এই ভাঙনে একজন বাবা পরিবারের অভিভাবক হিসেবে যে করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হন তারই গল্প
বলা হয়েছে এই সিনেমাতে।
বড়
ভালো লোক ছিল
বড়
ভালো লোক ছিলো, হ্যা সিনেমার এই নামের সাথেই জড়িয়ে আছে নায়ক রাজ্জাক। ১৯৮২ সালে মুক্তি
পাওয়া এই সিনেমাটি রাজ্জাককে অভিনেতা হিসেবে বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই সাথে
এই সিনেমা দিয়েই রাজ্জাক অর্জন করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
ছুটির
ঘন্টা
১৯৮০
সালে মুক্তি পাওয়া রাজ্জাক অভিনীত ‘ছুটির ঘন্টা’ ছিলো ব্যতিক্রমী এক গল্পের সিনেমা।
যদিও এটি একটি শিশু সিনেমা। গল্পটা ছিলো, স্কুলে ঈদের ছুটি যেদিন ঘোষণা করা হয়, সেদিনই
বাথরুমে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়ে ১২ বছরের এক ছাত্র। আর সেই বদ্ধ অবস্থাতেই কেটে যায়
১১ দিন। এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে ছিলেন রাজ্জাক। সিনেমায় তার নাম ছিলো আব্বাস।
আব্বাস ছিলেন সেই স্কুলের দপ্তরী। আর আব্বাস ভূমিকায় অভিনয় করে রাজ্জাক সকলের মন জয়
করে নেন। আর এই সিনেমার জনপ্রিয় দুটি গান হলো, “আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী” এবং “একদিন
ছুটি হবে”। আর এই গান দুটোর সাথে অনেকেরই ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িত।
ময়নামতি
১৯৭৯
সালে মুক্তি পাওয়া ‘ময়নামতি’ সিনেমাটি রাজ্জাক অভিনীত এক উল্লেখযোগ্য সিনেমা। কারণ
হলো, এটিই তার একমাত্র সিনেমা যা পরবর্তীতে রিমেক হয়েছে ‘অনেক সাধের ময়না’ নামে। এই
সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ২০১৪ সালে। সেখানে রাজ্জাক কবরীর জায়াগায় ছিলো বাপ্পি-মাহি।
জাস্ট ভাবেন একবার, পুরা সিনেমার ইজ্জত মেরে দিয়েছে। যাই হোক রাজ্জাক কবরীর ‘ময়নামতি’
সিনেমার বেশ কয়েকটি গান সেসময় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে, পাশাপাশি তাদের অভিনয়ও দর্শকের
মাঝে সাড়া ফেলে।
অনন্ত
প্রেম
‘আকাশ
যতোদিন থাকবে, এই পৃথিবী যতোদিন থাকবে, আমি যে তোমারই থাকবো’
১৯৭৭
সালে মুক্তি পাওয়া ‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার বিজ্ঞাপনে এই কয়েকটি লাইন ব্যবহার করা হয়েছিলো।
এই সিনেমাটি তখনকার সময়ে প্রচলিত সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। কেননা এই সিনেমার
শেষে বর্ডার পেড়িয়ে পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নায়ক-নায়িকা দুজনেই মারা যায়। তবে
মারা যাওয়ার আগে নায়ক তার নায়িকার ঠোঁটে চুমু খায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা কোনো
সিম্বলিক চুমু নয়, একেবারেই ডিরেক্ট চুমু। আর এ নিয়ে সেসময়ের বিখ্যাত সিনেপত্রিকা ‘চিত্রালী’-তে
“ঢাকার ছবিতে চুমু এলো” হেডলাইনে একটা নিউজ করা হয়। সাথে পুরো অর্ধেক পাতা জুড়ে সেই
চুমুর ছবি ছাপা হয়।
রংবাজ
১৯৭৩
সালে জহিরুল হক পরিচালিত “রংবাজ” সিনেমার মাধ্যমেই প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন
রাজ্জাক। ছবির ‘হৈ হৈ হৈ রঙিলা’ আর ‘সে যে কেন এলো না’ এই গান দুটো এখনো মানুষের মুখে
মুখে ঘুড়তে দেখা যায়। বাংলা সিনেমার পালে হাওয়া দেওয়ার জন্য এ সিনেমাটি বিরাট ভূমিকা
রেখেছে। রাজ্জাক তাঁর রোম্যান্টিক ইমেজ ভেঙে এই সিনেমাতে নিজেকে অ্যান্টি-হিরো হিসেবে
দাঁড় করিয়েছেন। সিনেমাতে তার সঙ্গে ছিলেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। আর এই সিনেমাটি দারুণ জনপ্রিয়তা
পেয়েছিলো।
জীবন থেকে নেয়া
জহির রায়হানের পরিচালনায় শেষ সিনেমা হলো “জীবন থেকে নেওয়া”।
এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। রাজ্জাক অভিনীত এটি কালজয়ী একটি সিনেমা। এই সিনেমাতে
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি দৃশায়ন হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
সময় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সিনেমায় একটা মিছিলের দৃশ্যে
দেখা যায়, গুলির শব্দ শুনে সবাই যে যার মতো পালাচ্ছে। দাবি নিয়ে আসা প্লাকার্ড, ফেস্টুন
একে একে পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়। এসময় রাজ্জাক মিছিলে আসা জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “আপনারা
পালাবেন না”। কিন্তু সবাই যে যার মতো জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে রাজ্জাক
পড়ে গেল রাস্তায়। এই সিনেমাটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একটি সিনেমা। বিশিষ্ট
চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির তাই এই সিনেমাকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী
চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
স্বরলিপি
‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, বলো কি হবে?’ গানটি শোনেননি
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুগ যুগ ধরেই গানটি তার সজীবতা ধরে রেখেছে। ১৯৭০ সালে
মুক্তি পাওয়া ‘স্বরলিপি’ সিনেমাতে রাজ্জাকের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন ববিতা। একই বছরে
রাজ্জাক অভিনীত আরও অন্তত ১০টি সিনেমা মুক্তি পায়। তবে এই সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা
অর্জন করে। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, ‘স্বরলিপি’ সিনেমাটি উত্তম কুমারের ‘দেয়া নেয়া’ সিনেমার
কপি। তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।
নীল আকাশের নিচে
১৯৬৯
সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে মুক্তি পায় “নীল আকাশের নিচে” সিনেমাটি। এটি
একটি রোমান্টিক সিনেমা। কাহিনী, গুন্ডাদের হাত থেকে নায়িকাকে বাঁচানোর পরে পরস্পরের
প্রতি অনুরাগ এবং ভালোবাসা তৈরি হয়। সময়ের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় সমাজের
উচ্চ এবং মধ্যবিত্তের সেই ভালোবাসা আর হাসি কান্নার গল্প। এই সিনেমার ‘নীল আকাশের নিচে’
গানটি এখনো দর্শকের মুখে মুখে শোনা যায়।
বেহুলা
১৯৬৬
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “বেহুলা” সিনেমার পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। সিনেমাটি নির্মিত
হয়েছে বাংলার প্রচলিত লোককাহিনী, হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের
উপাখ্যান অবলম্বনে। মূলত বলা হয়ে থাকে এই সিনেমার মাধ্যমেই রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে বেশ
ভালো হাওয়া লেগেছিলো, যা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো এক অনন্য পর্যায়ে। আর হা, এই সিনেমায় ছিলো
মোট ১৪ টি গান। সিনেমাটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলো।